পানি কী ?
আমরা সকলেই জানি পানি কি! কারণ পানি তো আমরা প্রতিদিনই পান করি। যখন আকাশ থেকে বৃষ্টি পড়ে আর আমাদের শরীর ভিজে যায়, তখন বৃষ্টির পানির সুখকর এবং অস্তিস্থিকর দুই রকম অভিজ্ঞতাই আমাদের আছে। গ্রীষ্মকালে নদী বা পুকুরে নেমে ইচ্ছে মত গোছল করার যে আনন্দ তার তুলনা নেই। বিজ্ঞান বলে পানি হলো এইচটুও; অবশ্য এটা বলার প্রয়োজন নেই বিজ্ঞানের এই ইকোয়েশনটি যারা স্কুল লেভেলেও পড়ে, তাদের কারো অজানা নয়। তবু যখন কেউ প্রশ্ন করে, তখন এর সোজাসুজি জবাব দিতে হয় পানি হলো দুই ভাগ হাইড্রোজেন আর একভাগ অক্সিজেন। আসলেই তাই পানির প্রতিটি মলিকোলাস দুটি হাইড্রোজেন পরমাণু আর একটি অক্সিজেন পরমাণু দিয়ে গঠিত।
হাইড্রোজেন নিজেই একটা গ্যাস আর অক্সিজেন? এটাও একটা গ্যাস। এই দুটো যখন একত্র হয়, তখন এটা আর গ্যাস থাকে না, হয়ে যায় তরল অর্থাৎ পানি। কিন্তু এটা এখন না হলেও এক সময় বিস্ময়ের ব্যাপার ছিলো- কিভাবে ঘটে? আমরা জানি হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেন যখন তাদের নিজস্ব স্বভাব বদল করে স্ফূলিঙ্গের সৃষ্টি করে, তখন একটা বিস্ফোরণ হয় আর এই বিস্ফোরণের ফলে সৃষ্টি হয় পানি। ১৯৩৭ সালে জার্মানীর এয়ার কার্গো জাহাজে এই রকম একটা ঘটনা ঘটেছিলো- ওটা ছিলো জার্মান জাহাজের লাস্ট ট্রিপ। জাহাজ এয়ার কার্গো হিনডেন বারি হাইড্রোজেন নিয়ে যাওয়ার সময় লেকহাস্ট অতিক্রমকালে আগুন ধরে যায়। নিউজার্সির এই শহরের উপর প্লেনে আগুন ধরে যাওয়ার পর হাইড্রোজেন স্বাভাবিকভাবেই বাতাসের অক্সিজেনের সংস্পর্শে আসে ফলে, জাহাজে সাধারণ তরল পানির সৃষ্টি হয়। এই পানি এত উত্তপ্ত ছিলো যে তা জাহাজ থেকে বের করা সম্ভব হয়নি।
ল্যাবরেটরীতেও কোনো কোনো সময় কৃত্রিম পানি তৈরি করা হয়- অবশ্য এগুলো কোনো সময়ই বিপদের কারণ হয়নি। ভূপৃষ্ঠ সৃষ্টির আগে পানি সৃষ্টি হয়েছিল বলে আমরা জানি- পানির মধ্যেই এই পৃথিবীর জমিন সৃষ্টি হয়েছে। এখন এটা অনুমান করা সত্যি কষ্টকর যে, পৃথিবীর এই বিপুল পরিমাণ পানি সৃষ্টির জন্য কত বড়, কি রকম প্রচন্ড বিস্ফোরণের প্রয়োজন হয়েছিলো।
যদি সব পানিই দুটি হাইড্রোজেন আর একটি অক্সিজেন পরমাণু দিয়ে তৈরি কিন্তু এসব পানির স্বাদ এক রকম নয়। পানির ৪৫০০ মলিকিউলসের মধ্যে একটি হেভি ওয়াটার থাকে। যা সাধারণ পানি থেকে ১১ গুণ ভারী। কারণ এর হাইড্রোজেন পরমাণুগুলো ভারী, আর এই ভারী পানিই পরমাণু শক্তি উৎপাদনে ব্যবহার হয়।
আরেক ধরনের পানি আছে এগুলোকে বলা হয় জুভিনাইল ওয়াটার। এই পানি তরল কিন্তু পাথর সলিউশন যুক্ত। পৃথিবীর গভীর তলদেশে এই ধরনের পানির অস্তিত্ব বিদ্যমান। এই পানি কিন্তু পৃথিবীর তলদেশের অন্যান্য পানিস্তরের মতো মুক্ত নয়। মূলতঃ পাথর গলে এক ধরনের কাদার সৃষ্টি করে এই পানি যখন পৃথিবীর গভীর তলদেশ থেকে একটু উপরে উঠে আসে, তখন এগুলো শিলায় পরিণত হয়ে যায়। আবার কোনো কোনো সময় এগুলো শিলায় পরিণত না হয়ে তরল আকারেই থাকে- এ পানিগুলো যেন চিরতরল যুবা পুরুষের মতো এ জন্যই একে বলা হয় জুভিনাইল ওয়াটার।
সাধারণ পানি যা আমরা পান করি; পুকুর নদী বা সমুদ্রে দেখি এগুলো কিন্তু বহুরূপী- এগুলো কখনো তরল, কখনো কঠিন আবার কখনো গ্যাসীয়। অথচ বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে পানি কঠিন আকার ধারণ করলেও এটা পানির উপর ভেসে থাকে যদি জমাট বরফ পানিতে ডুবে যেতো তাহলে পৃথিবীর সব হ্রদ নদী, সমুদ্র অথবা মহাসমুদ্রে জলচর প্রাণীর কোনো অস্তিত্ব থাকতো না। মাছ থেকে শুরু করে হাঙ্গর, কুমির, তিমি সবই মারা যেতো। পানিকে আমরা বায়ু প্রবাহিত না হলে স্থির দেখি কিন্তু পানি কোনো সময়ই স্থির নয়- প্রায় সব সময়ই পানি থেকে বা তৈরি হচ্ছে- কোনো কোনো সময় আমরা এগুলো খালি চোখে দেখি, আবার কোনো কোনো সময় দেখি না। শীতকালে পানি থেকে বা নির্গমন বন্ধ না হলেও পানি কিন্তু শীতল থাকে।
পানি থেকে ভূ-পৃষ্ঠের সৃষ্টি কিন্তু একদিনে হয়নি এ জন্য পানি হাজার হাজার বছর আলোড়িত করেছে। পাথরকে পানি চূর্ণ-বিচূর্ণ করে, পাথর প্রসারিত করে এক অজানা রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় ভূপৃষ্ঠের সৃষ্টি করেছে। তবু কিন্তু পানি পৃথিবীর সমগ্র ভূ-ভাগকে জাগতে দেয়নি- এখনো পৃথিবীর এক বিরাট অংশ বরফ আবৃত হয়ে আছে।
পানিতে যে কত জিনিস লুকিয়ে আছে এর গণনা বা পরিমাণ মানুষ পানির সাথে পরিচয়ের সাথে সাথে জানতে পেরেছে এটা কিন্তু ভাবা ঠিক নয়। সাগরের পানিতে লবণ মিশে আছে এ কথা জানতেও মানুষের অনেক দিন অপেক্ষা করতে হয়েছে আর কেন সাগরের পানি লবণাক্ত এর ব্যাখ্যা দিতে মানুষ কত কথা উপকথা, আর গাল-গপ্প তৈরি করেছে তার ইয়ত্তা নেই।
জাপানি একটি উপকথায় আছে, এক মাঝি যাদুর পাটা-পুতা নিয়ে নৌকা করে যাচ্ছিল। হঠাৎ নৌকা ডুবে মাঝি মারা যায, আর পাটা-পুতা তলিয়ে যায় সাগরের জলে- এই যাদুর শিল নূয়ায় শুধু লবণ তৈরি করতে পারতো- সাগরে ডুবেও এর কর্ম অব্যাহত আছে- তাই সাগরের পানি লবণাক্ত। এই রকম আরো কত গল্প কাহিনী আছে নোনা পানি নিয়ে অথচ আমরা যে পানি পান করি, তা যে খনিজ পানি- এটা জানা থাকলেও এটা কৃত্রিমভাবেও তৈরি করা যায়, বাজারে যে পানি মিনারেল ওয়াটার বলে যে পানি বিক্রি হয় তা কৃত্রিম মিনারেল ওয়াটার। তা ছাড়া যে সকল জুস এবং রঙ্গিন কোল্ড ড্রিংকস্ বাজারে বিক্রি হয়- সেগুলোও তো বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান মিশ্রিত পানি ছাড়া আর কিছুই নয়। নদী সাগরে মিশে যায়- আর সাগর নদীকে টানে। সাগরে এত বিপুল পরিমাণ পানি যে, সাগরের কাছে গেলে মনে হয় পানির রাজ্যে এসেছি অথচ আমরা প্রায়শই শুনে থাকি আমাদের কৃষকের পর্যাপ্ত পানির জন্য তাদের ফসল ফলাতে পারছে না। পানির কিন্তু পরিবর্তন নেই, পৃথিবী সৃষ্টির সময় পানি যেমন ছিলো, এখনো তেমনি আছে। এই পরিবর্তন কিন্তু পানির স্বাদ বা রংগের পরিবর্তন নয় এটা হলো উপাদানগত অর্থাৎ সেই আদ্যিকালে পানির মধ্যে যে উপাদানগুলো ছিলো, এখনো তাই আছে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন পৃথিবীর অভ্যন্তরে এমন পানিও হয়তো জমে আছে, যেগুলো যে অবস্থায় সৃষ্টি হয়েছিলো এখনো সেই অবস্থায়ই আছে- একটুও নড়াচড়া করেনি। আর বৃষ্টির পানি, আকাশ থেকে বৃষ্টির পানি ঝরছে কতকাল থেকে তার হিসাব আমাদের কাছে নেই। তবে মনে করা হয়- মানুষের সভ্যতা যখন আলোর মুখ দেখেনি, তারও বহু আগে থেকে আসমানের জলীয় বা বৃষ্টি হযে পৃথিবীর বুকে নেমে এসেছে। এই যে আদিকাল থেকে পৃথিবীর বুকে বৃষ্টির ধারা প্রবাহিত হয়েছে- তবু কিন্তু পৃথিবীর কোনো জায়গা জলাভূমি আর কোনো জায়গা মরুভূমি হয়ে গেছে, তবে জলাভূমিই হোক আর মরুভূমিই হোক- কোন স্থানই কিন্তু পানিশূন্য নয়- এমনকি সাহারা মরুভূমির নীচেও পানি আছে। আগেই বলা হয়েছে- পানি চক্রে পানির রূপান্তর ঘটলেও এর ক্ষয় নেই। এই চক্র অবিরাম চলছে। আমরা নদী-নালা, সাগর, মহাসাগরের পানির কথা বলেছি- পৃথিবীর চার-তৃতীয়াংশই তো পানি কিন্তু এই বিপুল পরিমাণ পানির মধ্যে প্রতিবছর মাত্র তিন হাজার ভাগের এক ভাগ বাীভূত হয়। পানির যত ক্ষুদ্র অংশই বাীভূত হোক না কেন- সাগর মহাসাগরগুলো যদি এত বিশাল না হয়ে ক্ষুদ্রাকৃতির হতো তা হলে পৃথিবীতে মরুভূমি ছাড়া আর আমরা কিছুই দেখতাম না। চাঁদে সাগরের অস্তিত্ব নেই- এ কারণেই হয়তো- ওখানে মরুভূমির সংখ্যা বেশি। অবশ্য সম্প্রতি গবেষণায় বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন যে চাঁদে পানির অস্তিত্ব রয়েছে- সেই পানি তরল না কঠিন তা তারা পরিষ্কার করতে পারেননি। মঙ্গলগ্রহে যাবার জন্য মানুষের চেষ্টার অন্ত নেই- মঙ্গলে মনুষ্যবিহীন রকেট ইতোমধ্যে পাঠানো হয়েছে। উপগ্রহ থেকে তোলা ছবি দেখে বিজ্ঞানীরা অনুমান করেছেন মঙ্গলগ্রহেও পানির অস্তিত্ব আছে কিন্তু সেটা অবশ্যই পৃথিবীর মতো বিপুল পরিমাণে নয়। জীবনের অস্তিত্ব মানেই পানি। পানি ছাড়া জীবনের অস্তিত্ব নেই। এ কারণেই বোধ হয় জীবনের গল্পের আগে পানির গল্প এসে যায়। এই বিশ্ব চরাচরে যখন কোনো জীবিত প্রাণী ছিলো না তখনও পানি ছিলো- একথা আগেই বলা হয়েছে। এ জন্যই ধারণা করা হয়, কোটি কোটি বছর আগে যদি পৃথিবীতে কোনো প্রাণীর অস্তিত্ব থেকেও থাকে তা ছিলো জলজ প্রাণী। জলজ প্রাণীর মধ্যে মাছ ছিলো- পাতাশুদ্ধ গাছ ছিলো সেগুলো পানির ঢেউয়ের সাথে মিশে থাকতো, এমন পাতলা আর ছোট্ট যে তখন দেখার কেউ থাকলে ওগুলো সে দেখতেই পেতো না। পৃথিবীর যেটুকু স্থলভাগ ছিলো, সেটুকু ছিলো শুধু পাথর আর শক্ত মাটি। অনুমান করা যায়, ঐ সময় সাগরের প্রবল জোয়ারে অনেক জলজ প্রাণী সাগর তীরে এসে আটকা পড়েছিলো- আর যারা ঢেউয়ের মধ্যেও পানির ভিতর ছিলো তারা বেঁচে গিয়েছিলো এখনো অনেক প্রজাতি হারিয়ে যাবার পর জলজ সেই প্রাণীকূলের অনেকগুলো এখনো বেঁচে আছে। যারা ডাঙ্গায় এবং জলে সমভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করতে পারে- সেগুলোই এখনো বেঁচে আছে।
কত বছর চলে গেছে এর হিসাব কেউ রাখেনি কিন্তু ডাঙ্গার প্রাণীও যে এক সময় জলের বাসিন্দা ছিলো, এ কথা প্রায় সকলেই স্বীকার করেন। জলে এবং ডাঙ্গায় প্রাণীকূলের মধ্যে এক সময় সবাই জলজ প্রাণী থাকলেও এদের আকৃতি আর আয়ূষ্কাল কিন্তু এক রকম ছিলো না। যেমন এখন ডাঙ্গার প্রাণীদের মধ্যে আকার-আয়তন এবং আয়ু সমান নয়- রং এবং প্রকৃতি তো ভিন্ন ধরনের- একথা কে না জানে? মানুষের আবির্ভাব পৃথিবীতে কবে হয়েছিলো, সে এক লম্বা ইতিহাস। জলজ জন্তুর সাথে মানুষের ইতিহাস মিলিয়ে ফেলার কোনো অবকাশ নেই, তবে এ কথা সবাই স্বীকার করেন যে, যেখানে জলাধার ছিলো সেখানেই মনুষ্য বসতি গড়ে উঠেছিলো, এমনকি গুহা মানবগোষ্ঠীও পানিশূন্য এলাকায় বাস করেনি। শিক্ষার্থীরা সবাই এ কথা স্বীকার করেন- যে, সাগরের পানি এক সময় লবণাক্ত ছিলো না, যখন থেকে স্থলভাগে মানুষের বিচরণ শুরু হয়, তখন থেকেই সাগর নোনা হতে থাকে- ক্রমান্বয়ে এটা ছড়িয়ে পড়ে। আবার এ কথাও বলা হয় যে, লবণাক্ত পানি থেকেই জীবন পয়দা হয়েছে- আমাদের দেহে প্রবাহিত যে তরল ধারা বইছে তার সবটুকুই লবণাক্ত।
পানির সঙ্গে মানুষের ইতিহাস জড়িত। বিজ্ঞানীরা অতীত খুঁড়ে যে সকল তথ্য পেয়েছেন এ গুলোর মধ্যে সমুদ্রের তলদেশে অনুসন্ধান করে এবং মাটি খুঁড়ে ফসলের সন্ধান পেয়েছে তাতে মনে হয়- পানি শুধু মানুষের জীবনধারনের ক্ষেত্রেই অপরিহার্য ছিলো না। মানুষের জীবনের প্রতিটি কর্মের সঙ্গেই পানির একটা সম্পর্ক ছিলো।
মানুষের আবির্ভাবের সাথে সাথেই মানুষ ভাব বিনিময় করতে পারতো না সত্য কিন্তু তারা চিন্তা করতে পারতো এবং মানুষ যখন এই পৃথিবীতে প্রথম বিচরণ শুরু করে, তখন থেকেই তাদের চিন্তা শক্তি ক্রিয়াশীল হয়- আর তারা চিন্তা করতে শিখেছিলো জলাধার, নদী এবং সমুদ্র দেখে।
মানুষের মধ্যে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ প্রমাণ নিয়ে হাজির হওয়ার আগে তারা অন্যভাবে বস্তুর ব্যাখ্যা দিতে পারতো। খৃস্টানদের ধর্মীয় পুস্তক ওল্ড টেস্টামেন্টে আছে-
পৃথিবীর তখন কোনো আকার ছিলো না, সব কিছু ছিলো শূন্য আর এই শূন্যতার মধ্যে গভীর অনুকার ছাড়া কিছুই ছিলো না, তখন ঈশ্বরের চেতনা পানির মধ্যে আবর্তিত হচ্ছিল। উক্ত পুস্তকে আরো লেখা আছে- এরপর ঈশ্বর আলো সৃষ্টি করলেন পৃথিবী সৃষ্টি করলেন এবং এতে জীবনের আগমন ঘটালেন। তিনি পানিকে পৃথক করলেন এতে শুষ্ক জমি আলাদা হয়ে গেলো। এই ধর্মগ্রন্থ যিনি রচনা করেছিলেন- তিনি কিন্তু বিজ্ঞানী ছিলেন না কিন্তু তার চিন্তার গভীরতা থেকে বুঝতে পারা যায় যে- পানি থেকে সৃষ্টির শুরু হয়েছিলো।
অবশ্য অন্যান্য ধর্মগ্রন্থে পানি থেকে জীবনের কথা উল্লেখ রয়েছে- হিন্দুদের প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ উপনিষদে বলা হয়েছে- পানি থেকেই জীবন এসেছে- পানিই হলো সব কিছুর মূল। হ্যাঁ পানি- এই প্রাচীন শাস্ত্রকারেরা কেউ বিজ্ঞানী ছিলেন না- একথা আগেই বলা হয়েছে কিন্তু তারা সঠিক তথ্যটিই তাদের চিন্তায় খুঁজে পেয়েছিলেন।
হিন্দুদের একটি প্রাচীন গ্রন্থে আছে- সৃষ্টির আদিতে এই বিশ্ব জলময় ছিলো, জল ছাড়া তখন কিছুই ছিলো না। মিশরীয় প্রাচীন ধর্ম সাহিত্যে একই কথা পাওয়া যায়- লর্ড অব অল এর ভাষ্যে বলা হয়েছে।
I am he who came into being as Khepri Heaven had not come into being. The earth had not come into being the creatures of the earth and the reptiles had not been made in that place. I lifted myself up from among them, out of the watery mass.....
এক সময় গ্রীস দার্শনিকেরা পৃথিবী সৃষ্টি ও জীবনের উৎপত্তি সম্পর্কে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। এই বাহাসে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ছিলো সাত। শেষ পর্যন্ত তারা সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পেরেছিলেন। এই সাত মহান ব্যক্তির মধ্যে যিনি পৃথিবীর সব কিছু পানি থেকে জন্ম নিয়েছে বলে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন তার নাম খেলাস। এটা সত্যিই বিষ্ময়কর যে, ঐ গ্রীক পন্ডিতদের মধ্যে কেউ বিজ্ঞানী ছিলেন না অথচ তাদের একজন তার প্রজ্ঞার আলোকে এমন একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে, সত্যটি এখন বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। মানুষের ইতিহাস আর পানির ইতিহাস একই সূত্রে গাঁথা। এখন মানুষ ও পানির কাহিনী বর্ণনা করবো। আদিম মানুষ যত্রতত্র ঘুরে বেড়াতো। এটাই ছিলো তাদের কাজ, তারা ছিলো আধুনিক মানুষ থেকে স্বতন্ত্র। তাদের জানার পরিধি ছিলো জটিল। কারণ তাদের পদে পদে বাধা অতিক্রম করে এমনকি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হতো। আজ অবশ্য আমাদের কারো জানতে বাকি নেই যে, পানি শুধু পিপাসা মিটানোর বস্তু নয়, পানি অনেক কিছু। জীবনের জন্য পানির প্রয়োজন এটা আদিম মানুষ জানতো, পৃথিবীর তাবৎ বস্তুর জন্যই পানি অপরিহার্য এটা কিন্তু তাদের জানা ছিলো না। শুধু তারা জানতো যেখানে তাদের ব্যবহারের জন্য প্রচুর বিশুদ্ধ পানি পাওয়া যাবে- সেখানেই হবে- তাদের আবাসস্থল। পানির জন্য লড়াইয়ের কথা অনেক এবং পানি নিয়ন্ত্রণের কাহিনী ইতিহাসেও তৈরি করেছে। এখন তো আমরা কলের মুখ খুললেই পানি পাই-এটা যদি না পাওয়া যেতো তা হলে আমরা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারতাম পানি কি চিজ। পানি ছাড়া শস্যক্ষেত, পাহাড় ঘেরা বনরাজি, ফুলের বাগান এবং পৃথিবীর তাবৎ পানি কুলসহ মৎস্যরাজি কোনো কিছুর অস্তিত্ব কি চিন্তা করা কোনোকালে মানুষের সম্ভব ছিলো?
এটা ছিলো পৃথিবীর কোনো এক প্রান্তের গ্রীষ্মের দুপুর যে সময়ের কথা আমরা বলছি সেই সময়কার ইতিবৃত্ত ইতিহাসে লেখা নেই- ধরে নেই জঙ্গলের মধ্য থেকে একটা লোক হামাগুড়ি দিয়ে গুহা থেকে বেরিয়ে এলো। তার চারদিকে সবুজ গাছপালা, গাছে গাছে পাখির কিচির মিচির, ঐ মানুষটা সতর্ক হলো কারণ এর আগে সে এই গুহার বাহিরের জায়গাটা এমনভাবে দেখেনি। কিছুক্ষণ সে জঙ্গলের পাশে দাঁড়ালো- তার ধারণা সে আরো নতুন নতুন পাখির ডাক শুনতে পাবে- এমন সময় তার কানে ভেসে এলো নদীর কুলুকুলু ধ্বনি- বয়ে যাওয়া পানির শব্দ। দিনটি ছিল রোদেলা এবং মানুষটি ছিলো তৃষ্ণার্ত। সে নদীর তীরে এসে উপস্থিত হলো- বহমান নদী। গাছের ছায়া পড়েছে নদীর তীরঘেঁষে পানির মধ্যে। সে তার হাত পানিতে প্রসারিত করে হাটু গেড়ে বসলো আর এক অঞ্জলি পানি নিয়ে মুখে ছিটিয়ে দিলো। আ! কি শান্তি। কি আনন্দ- তার পিপাসাই তাকে এই নদীর তীরে নিয়ে এসেছে। সে তার পরিচিত শব্দ করে গুহার ভেতরে থাকা শিশুটিকে ডাকলো শিশুটির মাও ছিলো গুহার ভেতরে- তাদের আসতে দেরি হচ্ছে তাই সে দুহাতে তুলে নিলো খরস্রোতা নদীর পানি কিন্তু নদী থেকে কয়েক কদম এগিয়ে যাবার পরই আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে সব পানি পড়ে গেলো এখন আর তার কিছুই করার নেই। পানি আছে কিন্তু সে তার শিশুও মায়ের জন্য নিতে পারছে না।
এর কয়েকদিন পর আবার সে নদীর তীরে এলো এবার আর কোনো ভয় নেই কিন্তু নদীতে পানি অনেক কমে গেছে। এটা জোয়ার ভাটার কারণে না ঋতু পরিবর্তনের জন্য সে বুঝতে পারলো না, তবে তার অভিজ্ঞতা তাকে জানিয়ে দিলো পানির এই স্বল্পতা মোটেই সুখকর নয়। এভাবে কতরাত কতদিন কেটে যায়, সে গুহার ভেতর প্রবেশ করে আবার বের হয়- পানি কখনো বাড়ে, কখনো কমে আবার কোনো সময় নদীর তলায় চলে যায়। সে স্মরণ করতে চেষ্টা করে প্রথম এক গ্রীষ্মের দুপুরে সে যখন এক অঞ্জলী পানি নিয়ে তার মুখে ছিটিয়ে দিয়েছিলো, সেদিন কি আনন্দই না জেগেছিলো তার মনে। পানি কোথা থেকে আসে নদী কোথায় চলে যায়? সে আকাশের দিকে তাকালো না আসমানে কোনো মেঘের চিহ্ন নেই। এখন শুধু দিনে নয় রাতে ও অন্য রকম লাগে। গাছের পাতাগুলো কেমন যে হয়ে গেছে। ঝরে পড়েছে মাটিতে। আর নদীর পানির প্রবাহ শীর্ণ হয়ে গেছে আদিম মানুষের চোখে বিস্ময়, তারা যখন রাতে আগুন জ্বালিয়ে আগুনের পাশে বসে থাকে, তখন একে অপরের দিকে তাকায়। তারা দেবতাকে সন্তুষ্ট করার জন্য নৃত্য করে। তারা মনে করে দেবতারাই বৃষ্টি নামাতে পারে, অসহায়ের মতো তারা আকাশের তারার দিকে তাকায়। বৃষ্টি নেই, নদীতে পানি নেই, বন্য প্রাণী হত্যা করে আদিম মানুষেরা তার রক্ত পান করে পানি পিপাসা নিবারণ করে। এভাবে তাদের জঙ্গলের আশপাশে যত বন্য প্রাণী ছিলো সব নিঃশেষ হয়ে যায়। স্ত্রীরা গুহার ভেতর থেকে বের হয়ে আসে- তারা পাথরের কুঠার ও ধারালো পাথ নিয়ে ঐ স্থান ত্যাগ করে পথ চলতে থাকে। আদিম রমনীর পিঠে গাছের লতা দিয়ে বাধা শিশু সন্তান- এখন আর কারো দিকে তাকানোর ফুরসত নেই- শুকনো গাছের ডাল ভেঙ্গে পড়ছে তাদের গায়ের কাছে, সামনে পাহাড়- তাদের ধারণা পাহাড়ের অপর পাশে প্রচুর পানি আছে। তাদের পিপাসা এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে, তাই তারা ভুলে গেছে পাহাড়ের অপর পার্শ্বে পানি থাকলে সেখানে দুর্ধর্ষ মানুষও থাকতে পারে- ঐ নির্দয় লোকগুলো তাদের তো পানি দিবেই না, বরং যারা পানি আনতে যাবে তাদের দেহের রক্তে ঐ পানি তারা লাল করে ফেলবে। তবু তারা ধীরে ধীরে পাহাড়ে ওঠে পাহাড়ের চূড়া থেকে পানির প্রবহমান ধারা দেখতে পায়- ধীরে ধীরৈ নেমে আদিম মানুষগুলো তাদের স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে পানির ধারে আসে। পানির কাছে এসে অর্ধেক পিপাসা দূর হয়ে গেছে, কি শীতল, কি স্বচ্ছ, সুস্বাদু পানি। মুখে তুলে দেয়ার সাথে সাথে পিপাসা দূর হয়ে যায়। শরীরে শক্তি ও মনে আনন্দ ফিরে আসে। একটু বসে বিশ্রাম নেবে এমন সময় কতগুলো অদ্ভূত লোক আদিম মানুষের এই ক্ষুদ্র দলটিকে আক্রমণ করে বসলো- তাদের হাতে গাছের ভাঙ্গা ডাল আর এদের হাতে ধারালো পাথরের অস্ত্র। কয়েক মুহূর্ত আঘাত-পাল্টা আঘাত। আক্রমণকারীরা পরাজিত হলো। তারা পাথরের অস্ত্রের আঘাতে মৃত্যুবরণ করলো। ঐ জায়গায় আধিপত্য দখল করলো, নতুন আগত এই আদিম মানবেরা। তাদের ভাগ্য ভাল- যে আক্রমণকারীদের তারা পরাজিত করতে পেরেছে না হলো তো, এখানেই এই নতুন দলটির জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটতো। শীতকালের পুরো সময়টাই আদিম মানুষের ক্ষুধা, কষ্ট এবং ভয়ে কাটতো। তাদের জানা ছিলো না কোন সময় বসন্তকাল আসবে। এর আগে অবশ্য বসন্তকাল এসেছে, কিন্তু ঐ সময় তো তারা দেবতাকে সন্তুষ্ট করতে পেরেছিলো এবার কি দেবতা তাদের ওপর সন্তুষ্ট হয়েছে, এবার কি বসন্ত আসবে এই পাহাড়ের গুহায়? তারা আবার কিছু বন্য প্রাণী হত্যা করে, তবে এবার এই প্রাণীগুলো হত্যা করা হয়, এদের রক্তপানের জন্য নয়- দেবতাকে সন্তুষ্ট করার জন্য। এরপর কালের চাকায় ঘুরে বসন্ত আসে- তারা ভয়মুক্ত হয়- দেবতারা তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে- আনন্দে তারা নৃত্য করতে থাকে।
আদিম মানুষের জীবন ছিলো পঙ্গু মানুষের মতো তারা হাঁটাচলা করতে পারতো ঠিকই কিন্তু প্রকৃতিদত্ত পানির ওপর তাদের কোনো কর্তৃত্ব ছিলো না। যখন তাদের পানির প্রয়োজন হতো তখন পানি পাওয়া ছিলো অনিশ্চিত আর এই অনিশ্চয়তা কাটানোর কোনো সহজ রাস্তাও তাদের সামনে ছিলো না। এই রকমভাবে যখন তাদের জীবন চলছিলো তখন বেঁচে থাকার এই অপরিহার্য বস্তুটিকে কিভাবে সহজলভ্য করা যায় এই ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করতে থাকে। এভাবেই কেটে যায় কয়েক শতাব্দী। তারা এই সময় অনেক কিছু শিখে- অনেক কিছু দ্যাখে এবং পানি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় বহন করে নিয়ে যাওয়ার জন্য পশুর চামড়ার মশক ব্যবহার করতে থাকে। এই সময় তাদের কাছে এই তথ্যও এসে যায় যে, মাটি খুঁড়লে পানি পাওয়া যায়- পানির পাত্রে পানি সংগ্রহ করে নিজেদের বাসস্থানে রাখার একটি সহজ কৌশল তাদের জানা হয়ে যায়। এরপর বৃষ্টির পানি ধরে রাখার চিন্তাও তাদের মাথায় এসেছিলো বলে জানা যায়। পানির মধ্যে গর্ত করে আকাশ থেকে ঝরা পানি তারা জমিয়ে রাখতো। হাজার বছর পর আমরা দেখতে পাচ্ছি মানুষ অনেক কিছু আবিস্কার করেছে- এখন আর মানুষ শুধু শিকার আর খাদ্য সংগ্রহের কাজে সারাক্ষণ ব্যস্ত নয়, সে খাদ্য উৎপাদন করতে শিখেছে। কৃষি কাজের জন্য যেকোনো সময় পানির প্রয়োজন আর সে পানি কিভাবে সংগ্রহ করতে হবে তারও একটা সহজ পন্থা বের করে ফেলেছে। মানুষের খাদ্য উৎপাদনের কথা ভাবতে হয়েছে অনেক বছর। কিভাবে নিজের খাদ্য নিজে ফলাবে এ চিন্তা করতে করতে মানুষ কয়েক হাজার বছর কাটিয়ে দিয়েছে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে- আদিম যুগে মানুষ ছোট ছোট বন্য প্রাণী হত্যা করে তাদের মাংস ছাড়া অন্য কোনো খাদ্যের কথা জানতো না- সেই বন্য প্রাণী যখন ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতে থাকলো, তখন তারা এর বিকল্প ভাবনা শুরু করলো। বিভিন্ন খাদ্য ভাবনায় পুরুষের সাথে নারীর ভূমিকাও কম ছিলো না। পুরুষেরা যেতো পশু শিকারে আর নারীরা গুহা থেকে বেরিয়ে বন-জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন শস্য এবং ফলের বীজ সংগ্রহ করতো। এই বীজ সংগ্রহ করে গুহার ভেতরে বা অন্য কোনো জায়গায় রেখে দিতো। অথচ ঐ সময় তাদের ধারণা ছিলো ফলগুলো স্বাদহীন আর এর বীজ শুষ্ক ও শক্ত। পর্যাপ্ত পরিমাণ বৃষ্টি না হলে গাছের ফলগুলো ও পরিপূর্ণ আকার পেতো না- যেখানে নদী থেকে বনের দূরত্ব বেশ দূরে হতো- সেখানেই এই ধরনের অবস্থা দেখা দিতো। নদী কাছে থাকলে নারীরা নদী থেকে মশকে ভরে অথবা কলসিতে করে পানি বহন করে নিয়ে যেতো এবং তারা সেখানে ফলের বীজগুলো ছড়িয়ে দিয়ে সেখানে পানি ঢালতো। পানি বহন করা কিন্তু সব সময় সহজসাধ্য ছিলো না। কারণ প্রায়শই দেখা যেতো ফলের গাছগুলো যেখানে জন্মেছে নদী থেকে তার দূরত্ব কম নয়। কোনো কোনো সময় পানি প্রবাহের জন্য নারীরা ধারালো পাথরের অস্ত্র দিয়ে মাটি কেটে নালার সৃষ্টি করতো এবং ঐ জলের ধারা তারা তাদের রোপিত শস্যক্ষেত বা ফলের বাগান পর্যন্ত নিয়ে যেতো।
ঐ সময় আদিম মানুষের জীবন ধারনের জন্য কত রকম কাজ যে করতে হতো, তার ফিরিস্তি আমাদের জানা নেই, তবে এটা অনুমান করতে কষ্ট হয় না যে, তারা শুধু ক্ষুধা নিবারনের জন্য সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকতো না, কিছু চিন্তা ভাবনাও করতো- এ ভাবে কেটে গেলো কত বছর তারা ভাব বিনিময়ের জন্য শব্দ আবিষ্কার করলো, যদিও তাদের সেই শব্দভান্ডার খুব বেশি ছিলো না কিন্তু যতই সময় অতিবাহিত হতে থাকলো, তাদের শব্দ ভান্ডার ততোই বেড়ে গেলো। এভাবে শব্দ বাড়তে বাড়তে তারা একদিন লক্ষ্য করলো যে, তারা সত্যি একটি নতুন ভাষা আবিষ্কার করে ফেলেছে। তারা চিন্তা করতে শিখেছে- মন শান্ত, অশান্ত হওয়ার কারণগুলো বুঝতে পেরেছে। বন্য প্রাণী থেকে যে মানুষ আলাদা এই বোধটুকুও তাদের মধ্যে এসে গেছে। তবে তারা জীব থেকে অঙ্কুরোদগমের প্রক্রিয়ায় কিভাবে যত্ন নিতে হবে, সেটা পুরোপুরি জানতে পারেনি। গুহার বাইরে বীজ ফেলে রাখতো আর গাছ হয়ে গেলো- তারা বীজ ছড়িয়ে রাখতো, যখন সঠিক সময় তখন আর যখন বীজ থেকে চারা হবে না, তখনো। অবশ্য ইউরোপের কোনো কোনো মহিলা কোন সময় বীজ মাটির বুকে ছড়িয়ে দিতে হবে- নিজস্ব পর্যবেক্ষণে তা আয়ত্ত্বে এনেছিলো- তারা বুঝাতে পেরেছিলো যে, যে গাছ বীজ দিয়েছে তা ঝরে যাবে আর বীজ থেকে যে গাছ ঝরে গেছে সেই রকম একটা গাছ হবে। শস্যবীজ সমতল ভূমিতে আদিম নারীই প্রথম বপন করেছিলো। তারা বীজ সংগ্রহ আর সংরক্ষণ করতো এবং পুরুষের অগোচরে সেগুলো মাটিতে বপন করতো। কিন্তু এতে পর্যাপ্ত পরিমাণ শস্য ফলতো না। এর পর তারা ভাবতো লাগলো কি করে প্রতিটি বীজ থেকে চারা পেতে পারে আর প্রতিটি চারা থেকে শস্যদানা তাদের ঘরে তুলে নিতে পারে। অতিবৃষ্টি আর অনাবৃষ্টিতে শস্যেরও ক্ষতি হয়। মাটিকে উলট-পালট না করলে ভাল শস্য জন্মে না এই ধারণা তখন তাদের মধ্যে এসে গেছে, তাই ধারালো পাথর দিয়ে মাটি কাটা শুরু করেছে তারা। মানুষ সম্ভবত ঐ সময় জেনে গিয়েছিলো কিভাবে বৃষ্টি না হলে ও কি করে সেচের সাহায্যে সফল উৎপাদন করা যায়। ঐ সময় সকল পুরুষই ছিলো শস্য উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। এই কাজ ছাড়া তাদের অন্য কোনো কাজ ছিলো না। তারা প্রবাহমান নদীর দিকে তাকাতো আর শুষ্ক বাগানের দিকে দৃষ্টিপাত করতো- এতথ্যে কেউ হয়তো তাদের পানি ও বৃক্ষের পরস্পর অপরিহার্য্যতা সম্পর্ক ধারণা জন্মেছিলো। মাটির কলসীতে করে পানি বয়ে এনে গাছের গোড়ায় অথবা শস্য খেতে দিতে যত কষ্টই হোক, তারা ঐ কষ্টটুকু স্বীকার করেই প্রথম কৃষি কাজে ব্যস্ত হয়। তবে এ কাজে একটা ফাঁক ছিলো- কোনোভাবেই শস্যের পরিমাণ মতো পানি তারা যথাসময়ে দিতে পারেনি। ফলে আবার সেই দেবতার উদ্দেশে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা, আবার সেই দেবতাকে সন্তুষ্ট করার জন্য উন্মুক্ত নৃত্য। কিন্তু তবু দেবতা সদয় হয় না। সময় মতো বৃষ্টি হয় না, ফসল পুড়ে যায়, গাছ মরে যায়। আবার তার ভাবনা, ফসলের ক্ষেতে, বাগানে কি করে আরো ভাল উপায়ে পানি আনা যায়। এ সময়ই বোধ হয় তাদের মাথায় খাল কাটার চিন্তা এসেছিলো, খাল কেটে শস্যক্ষেতে পানি প্রবাহের পন্থা যখন তারা জেনে গেলো, তখন তাদের খাদ্যাভাব দূর হয়ে গেলো। আদিম মানুষ সেচ পদ্ধতি আবিষ্কার করে ফেললো। আর পানি প্রবাহের জন্য খাল খনন করতে গিয়ে তারা যৌথভাবে কাজ করার তাগিদ অনুভব করলো। মূলত পানিই তাদের একত্রে কাজ করতে উদ্ধুদ্ধ করেছিলো। অসংখ্য খাল কেটে শস্যক্ষেতে পানি প্রবাহের ফলে তাদের রোপিত গাছগুলো সবল হওয়ে উঠলো। খালের দু'ধারে নির্মিত হলো বসত বাড়ি। আদি মানুষ বিচ্ছিন্নতা থেকে সামাজিকতায় ফিরে আসতে লাগলো। যে সময়ের কথা এখানে বলা হচ্ছে প্রকৃত পক্ষে তখনো আদিম মানুষের মধ্যে সভ্যতার ছোঁয়া লাগেনি- কিন্তু তারা বুঝতে পেরেছিলো উঁচু এলাকা থেকে নদী খাল যে মাটি বয়ে এনে শস্যক্ষেতে ছড়িয়ে দেয়, সেটা জমিকে ঊর্বর করে আর জমি উর্বর হলে শস্য ভাল হয়। মানুষের কূপ খননের কৌশল খাল কাটার পরই আয়ত্তে এসেছিলো। কূপ খননের জন্য ও যৌথ প্রচেষ্টার প্রয়োজন, তাই তারা যৌথভাবে কূপ খনন শুরু করলো আর যেখানে কূপে সুপেয় পানি পাওয়া যেতো সেখাইে মানুষ বসবাসের জন্য ভিড় জমাতো। তাদের মধ্যে একটি অলিখিত আইন চালু হলে গিয়েছিলো যে, কোনো কূপই বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর অধিকারে থাকবে না, কূপ হবে সকলের- সেখান থেকে সবাই প্রয়োজনীয় পানি সংগ্রহ করতে পারবে। এভাবে সবার প্রয়োজনের প্রতি নজর দেয়ায় এবং একত্রে বসবাস করার চিন্তা থেকে জীবন অনেকটা সহজসাধ্য হয়ে গেলো। আগে যেখানে একা শত্রুর মোকাবিলা করতে হতো সেখানে সম্মিলিতভাবে শত্রুর মোকাবিলা করতে এগিয়ে এলো তারা। ভূতাত্ত্বিকেরা- গবেষণা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, এরিজন এবং নিউ মেক্সিকোতে যে সমস্ত অঞ্চল এখন মরুভূমি এক সময় ঐখানে একাধিক নদী ছিলো। ঐ মরুভূমি অঞ্চলে কয়েকশ বছর আগে রেড ইন্ডিয়ানদের বসবাস ছিলো বলেও তারা মনে করেন। নদীগুলোতে পলি জমে জমে লম্বা ঘাস জন্মাতে থাকে শেষে পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ধীরে ধীরে মরা প্রক্রিয়া শুরু হয়ে দেশটি মরুভূমিতে পরিণত হয়।
প্রত্নতাত্ত্বিকেরা খনন করে ঐ সব অঞ্চলে যে সকল মানুষের হাড় এবং তৈজসপত্র পেয়েছেন তাতে তাদের বিশ্বাস আরো দৃঢ় হয়েছে যে, ঐ জায়গায় এক সময় জনবসতি ছিলো তারা রুটি খেতো, এমন কি এখানে নগরও গড়ে উঠেছিলো। আমরা যে সব অঞ্চল এবং মানুষের কথা বলছি, তাদের অবস্থান ঐ অঞ্চলে কয়েকশ বছর আগে অথবা কয়েক হাজার বছর আগেও হতে পারে স্বাভাবিকভাবেই মানব ইতিহাসে সভ্যতার শুরু হয়নি। সভ্যতার শুরু নদী কেন্দ্রিক- টাইগ্রিস এবং ইউফ্রেটিস নদীর তীরে এবং মিসরের নীল নদীর তীরে এশিয়া মাইনরে প্রথম সভ্যতা গড়ে ওঠে। এই সব জায়গায় তারা এক দিকে নদী এবং অপরদিকে পর্বত দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিলো- সে কারণে শত্রুর কবল থেকে একটি প্রাকৃতিক বলয়ও তাদের জন্য তৈরি হয়েছিলো- এখানে তারা প্রাচীন সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিলো বলে পন্ডিতেরা মনে করেন।
(চার)
আমি পানিকে করবো সহজলভ্য-
আর মরুভূমিকে বানাবো ফুলের বাগান
-হাম্বু রাবি, ব্যাবিলনের রাজা (খ্রিস্টপূর্ব ২১০০ অব্দ)
প্রাচীন মিসরে পানির খুব অভাব ছিলো, স্বাভাবিকভাবেই সেখানে বৃষ্টি হতো না। তবু শুধু নীল নদের বদৌলতে মিসরে প্রচুর শস্য উৎপন্ন হতো। নীল নদের পানির প্রবাহে এবং প্লাবন প্রতিবছর এক রকম হতো না। মিসরের লোকেরা মনে করতো এবার প্লাবন হয়েছে এটা বোধ হয় আর যাবে না- আবার যখন পানি দেরীতে আসতো তখন মনে করতো এবার বোধ হয় নদীতে পানিই আসবে না। তাই খাল কেটে বন্যার সময় পানি জমিয়ে রাখা তারা বুদ্ধিমানের কাজ ধরে নিয়েছিলো এবং সেভাবেই তারা শস্যক্ষেতে পানির অভাব পূরণ করতে সচেষ্ট হয়েছিলো। পানি আনয়নের প্রয়োজন হয়েছিল যখন খাল বা নালা তৈরি হয়নি অথবা নদীর তীরগুলো ছিলো উঁচু আর পানি থাকতো নদীর তলায়। কলসি বালতি ভরে পানি লোকজন তাদের আবাসস্থলে নিয়ে আসতো শস্যক্ষেতে পানি টেনে এনে ভিজিয়ে দেখাকে মিসরীয়রা বলতো, ‘স্যাডোফ' কূপ থেকে পানি তুলে কোনো কোনো জায়গায় ফসলের ক্ষেতের শুষ্কতা দূর করা হয়। এখন যে ভূগর্ভের পানি নলকূপের মাধ্যমে তোলা হয় তখন তোলা হতো দড়ি বা বালতি দিয়ে। দু'টি খুঁটি গেড়ে খুঁটির দু'মাথায় আড়াআড়ি করে বাঁশ বা কাঠের দন্ড বাঁধা হতো এর সাথে যুক্ত হতো কপিকল এবং গড়ি আর দড়ির একপ্রান্তে বালতি অপর প্রান্ত থাকতো যে পানি তুলবে আর হাতে। শূন্য বালতি কূপের মধ্যে ছেড়ে দিয়ে পানি ভর্তি হলে দড়ির অন্য প্রান্ত আস্তে আস্তে টানলেই কিছুক্ষণ পর পানি সমেত বালতি উঠে আসতো। মিসরীয়রা অন্যভাবেও পানি তোলার ব্যবস্থা করেছিলো তারা একটি চাকার মধ্যে দড়ি পেঁচিয়ে এক প্রান্তে বেশ বড় বালতি অন্য প্রান্তে ষাড়ের গলায় পেঁচিয়ে রেখে কূপের চারদিকে ষাড়কে ঘুরিয়ে পানি তুলতো। ষাঁড়ের এই ঘূর্ণন ছিলো অনেকটা কলুর বলদের ঘানি টানার মতো। তারা ষাঁড় দিয়ে পানি তোলার এই পদ্ধতিটির নাম দিয়েছিলো ‘সাকিয়া'। এই পদ্ধতিতে পানি তোলার সময় যে আওয়াজ হতো- তা কর্মব্যস্ত দিনেও বহু দূর থেকে মানুষের কর্ণগোচর হতো। মিসরের কৃষি কাজে জড়িত কোনো লোকই সারাদিন এই কাজ করতো না। কারণ তাদের জমি ছিলো উর্বর এবং নদীর বদৌলতে বিনা পরিশ্রমেই শস্যক্ষেতগুলো প্রয়োজনীয় পানি পেতো। তারা দিনের এক ভাগ শস্য উৎপাদনের কাজে ব্যস্ত লোক অন্যভাবে গান বাজনা, চিত্রাঙ্কন, অজানাকে জানার জন্য জ্ঞান চর্চা করতো এবং তাদের জ্ঞানলব্ধ তথ্য ঐ সময়ের প্রচলিত ভাষায় লিখে রাখতো। স্বাভাবিকভাবেই মিসরে একটি প্রাচীন সভ্যতা গড়ে উঠার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। সকল মিসরীয় জনগণই যে এভাবে হেঁসে খেলে জীবন কাটাতো, তা কিন্তু নয়। তাদের মধ্যে অনেক ক্রীতদাসও ছিলো। যাদের দিন রাত পরিশ্রম করতে হতো। প্রাচীন মিসরের ভূ-ভাগ ছিলো পর্বতমালা এবং সমুদ্রবেষ্টিত। ফলে তারা সব সময় শঙ্কিত থাকতো পাহাড়ের অপরদিক থেকে অথবা সমুদ্র থেকে কোন জনগোষ্ঠী না তাদের আক্রমণ করে বসে। এই শঙ্কা থেকেই তারা দেশের মধ্যে একটি নিরাপত্তা ব্যবস্থা চালু করেছিলো এছাড়াও নদী ও নদের পানিকে উজান থেকে বাঁধ দিয়ে বা পানির প্রবাহ ভিন্ন পথে প্রবাহিত করার হুমকি শোনা যেতো কোনো কোনো সময়। ইথোপিয়ার রাজপুত্র এক সময় প্রকাশ্যে এই হুমকি দেয়ায়, মিসরের শাসনকর্তা তাকে প্রচুর উপটৌকন দিয়ে তাকে নিবৃত্ত করেন। টাইগ্রিস এবং ইউফ্রেটিস নদীর উভয় তীরে গড়ে ওঠা সভ্যতাই এশিয়া মাইনরে প্রাচীন সভ্যতা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। প্রত্নতত্ত্ববিদগণ মনে করেন, প্রাচীন মিসরেই হয়তো ইডেন সাড়িনের অস্তিত্ব ছিলো যা আমরা বাইবেলে স্বর্গীয় উদ্যান রূপে উল্লেখিত হয়েছে বলে মনে করি।
সুশারিয়রা আফ্রিকার দক্ষিণ অঞ্চলের যে অংশে বসতি গেড়েছিলো বর্তমানে ঐ অংশের নাম ইরাক। প্রায় ছয় হাজার বছর আগে নীল নদের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতে খুবই কম বৃষ্টিপাত হতো এই অঞ্চলে প্রচুর খাদ্যশস্য উৎপন্ন হওয়ার একমাত্র কারণ ছিলো নদী থেকে শস্যক্ষেতগুলোতে পানির ব্যবস্থা। এটা ছিলো নিরাপদ এবং উর্বর এলাকা- এই এলাকার লোকজন যারা মরুভূমিতে বাস করে তাদের দেখতে পারতো না। কিন্তু নদী থেকে খাল কেটে যখন জমির কাছাকাছি পানি নেয়া হতো সেই খাল কিন্তু মরুভূমি থেকে খুব দূরে ছিলো না। এটা ছিলো খুবই ভাল জায়গা আর সব মানুষই এখানে বসবাস করতে চাইতো।
বার বার পাহাড় থেকে ঐ উর্বর জমির ফসল লুট এবং মানুষের ওপর আক্রমণ হতো। ২১০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ পর্যন্ত এই ধারা চলে এরপর ব্যাবিলনীয়রা মিসর দখল করে নেয়।
বসন্তে যখন বৃষ্টি হতো, এ বৃষ্টিতে মিসরের নীল নদ এবং এ থেকে কেটে নেয়া খালগুলো পূর্ণ হতো না। তবে এতে যে পলিজমা হতো সেই পলিমাটি ব্যাবিলনীয়রা ঝুড়িতে করে জমিতে ফেলতে শুরু করে প্রথমে শত শত শ্রমিক এ কাজে নিয়োগ করা হয় পরে হাজার হাজার। এভাবেই প্রতিবছর খাল কেটে মাটি তোলার জন্য যে শ্রম শক্তি নিয়োগ করে, এতেই তাদের ফসলি জমিগুলো মরুকরণ থেকে রক্ষা পায়।
কিন্তু বেশিদিন এটা টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। মিসরীয়দের সাথে মিশে ব্যাবিলনিয়রাও নৃত্যগীতি চর্চায় মেতে উঠে। এ কারণে তাদের মধ্যে যে কর্মের প্রবাহধারা সক্রিয় ছিলো তা ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যায়। ওদিকে পারশিক ও আলেকজান্ডারের আক্রমণের ভয় তো ছিলোই- এর পর মোঙ্গলীয়রা সেখানে এমন তান্ডবের সৃষ্টি করে যে, তাদের সবকিছু মিসমার করে সেচ ব্যবস্থাও সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ফেলে। এ কারণে আর নীল নদের তীরে বাড়তি কোনো জনবসতি গড়ে উঠেনি। বরং জনবসতি হ্রাস পেতে পেতে কিছু উপজাতীয় এবং বেদুইন ছাড়া আর সব মানুষ অন্যত্র আস্তানা গাড়ে।
এদিকে ফোরাত (ইউফ্রেটিস) নদীর পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত ইরাকে এর প্রভাব মারাত্মক আকার ধারণ করে। পানি সেচ বন্ধ থাকার কারণে ওখানে স্বাভাবিকভাবেই মরুভূমির সৃষ্টি হয়। এই মরুভূমির বালুকণার স্তরগুলোর মধ্যে ভাঙ্গা মৃৎশিল্পের নিদর্শন পাওয়া যেতো- এটা মরুভূমিতে পরিণত হয়েছিলো সেই কবে। কিন্তু এই মৃৎশিল্পের নিদর্শন কয়েক বছর আগেও পাওয়া গেছে। যে মরু এলাকার ভঙ্গ মৃৎপাত্র পাওয়া গেছে বা এখনো যার চিহ্ন আছে সম্ভবত! তিন থেকে চার হাজার বছর আগে হয়তো সেখানে গ্রাম ছিলো। প্রাচীন ব্যাবলিনের এই গ্রামের রূপ কেমন ছিলো তা অবশ্য এখন অনুমান করা কঠিন কিন্তু সেখানেও যে সভ্যতার ছোঁয়া আলতোভাবে লেগেছিলো প্রাপ্ত নকশা করা ভাংগা মৃৎপাত্রের নমুনা থেকে তা বুঝা যায়। এ মরুভূমির ওপর দাঁড়ানো এখনো বালির পাহাড় চোখে পড়বে- এই বালুর পাহাড় কি এমনি এমনি তৈরি হয়েছে না যখন জনবসতি ছিলো তখন তারা তৈরি করেছিলো? প্রত্নতাত্তিকেরা এই এলাকায় খনন করে অনেক প্রাচীন নির্দশন পেয়েছেন যেখানে সবচেয়ে বেশি প্রত্নতত্ত্ব পাওয়া গেছে অনুমান করা হয় ওখানেই ছিলো ব্যালিন নগরী। মরুভূমিতে হাঁটতে হাঁটতে কোনো কোনো সময় দেখা যায়, মাঝখানে বালুকারাশি আর দুই দিকে নদীর তীরের মতো উর্বর করা সম্ভব। কৃষকেরা আবার তাদের সব জমিতে শস্য ও গাছপালা রোপণ করাতে দেখা গেলো এতকাল যে জায়গাটি মরুভূমি ছিলো সেখানে সবুজের ছোঁয়া লেগে জনবসতি গড়ে উঠেছে। মানুষ এভাবেই মরুভূমিকে জয় করেছে, পৃথিবীর কিছু উল্লেখযোগ্য সভ্যতা গড়ে উঠেছিলো মরুভূমিতেই কারণ মানুষ পানির ব্যবহার জানার পর মরুভূমিতে ফুলের বাগানে পরিণত করেছিলো। প্রাচীন রোমান জাতি পানির ব্যবহার করে দক্ষিণ আফ্রিকা একটি সুন্দর সুসভ্য জাতি হিসেবে পরিচিত হয়। এভাবেই ভূমধ্য সাগরের তীরে সভ্যতা গড়ে উঠে। ঐ সভ্যতা যদি না গড়ে উঠতো তাহলে হয়তো আমরা বর্ণমালাই পেতাম না। প্রাচীন মেক্সিকোর এবং মধ্য আমেরিকার অধিবাসীরা সেচের সাহায্যে তাদের শস্যক্ষেত্রগুলোকে সবুজ রেখেছিলো ইঙ্গফা ইন্ডিয়ান এবং পেরুর লোকজন তাদের ক্যানেলগুলোর তত্ত্বাবধানের ভার ছেড়ে দিয়ে ছিলো সরকারের হাতে যাতে সর্বসাধারণ এগুলো ব্যবহার করতে পারে। অন্যদিকে চীনারা প্রায় দুই হাজার বছর আগে ছোট ছোট নদী এবং খাল খনন করে তাদের সেচ ব্যবহার আয়োজন করেছিলো। তুর্কিরা তাদের সেচ ব্যবস্থা করেছিলো সম্পূর্ণ অন্যভাবে তারা মূল নদীতে বাঁধ দিয়ে পানি আটকিয়ে ঐ পানি খাল এবং নালা কেটে জমিতে নিয়ে যেতো এভাবেই তারা মরুভূমিকে শস্য ভূমিতে পরিণত করে। প্রাচীণ মানুষ কিভাবে এই পদ্ধতি জেনেছিলো এটা অবশ্য এখানো আমাদের অজানা কিন্তু তারা যে সভ্যতা গড়ে তুলেছিলো, তা কিন্তু ইতিহাসের পাতায় লেখা রয়েছে।
৫. প্রাচীন সভ্যতা গড়ে উঠার ক্ষেত্রে পানির ভূমিকা ভূমির চেয়ে কম ছিলো না। এই দু'টো যখন পর্যাপ্ত পরিমাণে কোনো জায়গায় একত্রে পাওয়া যেতো সেখানেই প্রাচীন জনগোষ্ঠী সভ্যতা গড়ে তুলতে সচেষ্ট হতো। যখন মানুষ চাষাবাদ শিখলো তখন তারা বৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলো। বৃষ্টির ওপর নির্ভর করে মানুষের চাষাবাদ চলছে অনেকদিন। কোথাও সময় মতো বৃষ্টি না হলে ঐ জিম পরিত্যক্ত অবস্থায় রেখে নতুন জায়গায় গিয়ে চাষাবাদের জমি খুঁজেছে প্রাচীন মানুষ। জমির অপব্যবহার প্রাচীন মানুষের জন্য কোনো সমস্যা ছিলো না। কারণ প্রাচীন মানুষ দীর্ঘদিন এক জায়গায় বেশিদিন কোনোকালেই থাকেনি। এ জন্য যে, তখন জনসংখ্যা ছিলো কম। সমস্যা সৃষ্টি হয় পরবর্তী সময় যখন তারা পাহাড়ের পাদদেশে শস্যভূমি তৈরি করে এবং প্রবল বর্ষণে সেগুলো ভেসে যায়। তাদের তখন চাষাবাদের সঠিক ধারণা গড়ে উঠেনি তাই কোন জমিতে তারা স্থায়ী চাষাবাদের ব্যবস্থা গড়ে তুলবে এ ব্যাপারে ছিলো অজ্ঞাত। হাজার বছর আগে মানুষ ভাবেনি তারা যাযাবরের মতো ঘোরাঘুরি না করে স্থায়ীভাবে এক জায়গায় বসবাস করতে পারে।
দীর্ঘদিন সভ্যতা টিকিয়ে রাখার সমস্যা ছিলো পানির ব্যবহার এবং দেশের নিরাপত্তা। আমরা দেখেছি ব্যাবিলনীয়রা কিভাবে পলিমাটি তাদের খালগুলো থেকে সরিয়ে ফেলার জন্য প্রতিবছরই পুনঃখননের ব্যবস্থা করেছে। এই পলিমাটি অনেক দূর থেকে নদীগুলো দ্বারা বাহিত হয়ে আসতো। পাহাড় থেকে নদীতে ঘোলা পানির সাথে এই মাটি চলে আসতো। এ্যাসেরিয়ানরা পাহাড়গুলোকে বৃক্ষশূন্য করার সময় একবারও ভাবেনি প্রবল বৃষ্টিপাত হলে পাহাড়ের কি অবস্থা হবে। তারা ভাটির দেশ ব্যাবিলনের নদীগুলো যে পাহাড়ি মাটিতে ভরে যেতে পারে এ জ্ঞান ও বোধহয় তখন তাদের ছিলো না।
এক গ্রীক দার্শনিক তার দেশের পাহাড় এবং নদী সম্পর্কে কিছু বলে ছিলেন কিন্তু এই নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে সম্প্রতি গবেষকেরা দেখেছেন যে, এই মহান দার্শনিক মানবীয় অন্যান্য বিষয়ের সাথে পরিবেশ বিষয়েও তার মতামত রেখেছিলেন- তিনি বলেছিলেন, গ্রীসের পাহাড়গুলো মৌমাছি ছাড়া আর কিছুই ধরে রাখতে পারেনি, অথচ এই পাহাড়গুলো খুব বেশিদিন আগেও এমন ছিলো না- এখানে সুন্দর সুন্দর বিশাল বৃক্ষ ছিলো, এগুলো বড় বড় অট্টালিকার ছাদে ব্যবহার করার জন্য কেটে ফেলা হয়েছে। কিন্তু বছর বছর যে বৃষ্টি হয়, তা তো থেমে নেই- সে বৃষ্টির পানি নদী দিয়ে প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে পাহাড়ি ঢল হয়ে সাগরে গিয়ে পড়ছে। আর এর মাটিগুলো কোনো না কোনো দেশের মাটির সংগে মিশে গেছে।
প্লেটো বলেছেন পানিই হচ্ছে পৃথিবী, বসন্ত এলেই নদীতে পানি আসে আর সমগ্র দেশে তা ছড়িয়ে পড়ে। অনেকেই জানে না এই পানির ব্যবহার কিভাবে করতে হবে। এই পানি অনেক সময় দীর্ঘদিনও থাকে, দীর্ঘদিন থাকলে তো তখন তাদের সেই পানি নিয়ন্ত্রণভাবে ব্যবহার করা সম্ভব হয় না। এই পানি মানুষের ক্ষতি করে জমির ক্ষতি করে এমন কি আবহাওয়ারও পরিবর্তন করে।
ইতিহাসে দেখা গেছে, মানুষ সব সময়ই ভূমির অপব্যবহার করেছে। প্লেটো এ ব্যাপারেও মানুষকে সতর্ক করেছিলেন। বর্তমানেও আমরা দেখছি পানি ও জমির অপব্যবহারে আমাদের কি দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। পানির অন্য ব্যবহারের কথা জানা যায়নি, মানুষ পানি ব্যবহার করেছে শুধু তার নিজের জন্য, মানুষ পান করার জন্য পানি ব্যবহার করেছে, ধৌত করার জন্য পানি ব্যবহার করেছে কিন্তু তবু মানুষের একটি সমস্যা সব সময় থেকে গেছে, তা হলো- আরও পানি কোথায় পাওয়া যাবে এবং কিভাবে সে এর ব্যবহার করবে। প্রাচীনকালে মানুষ এই সমস্যার সমাধান করেছে পানির কাছে গিয়ে আর এখন মানুষ এর সমাধান করে পানি তার নিজের কাছে এনে। অনেক কারণের মধ্যে একটি কারণ হচ্ছে যেখানে পানি সহজলভ্য নয়, সেখানে মানুষ বসবাসে আগ্রহী হয় না।
বাইবেলে পাওয়া যায় মূসা নবীর পানির সমস্যা হয়ে ছিলো যখন তিনি ইসরাইলীদের নিয়ে মিসর ত্যাগ করেছিলেন। মূসা যখন তার লোকজন নিয়ে মিসরের বাইরে চলে আসেন তখন দারুণভাবে পানির অভাব দেখা দেয়।
তখন মানুষের খাবার পানি ছিলো না, পানি পিপাসায় মানুষ কাতর হয়ে পাগল হয়ে গিয়েছিলো, তারা উচ্ছৃংক্মখল হয়ে উঠলো। মূসার বিরুদ্ধে তারা বলাবলি করতে লাগলো যে আমাদের মিসর থেকে নিয়ে এসেছে আমাদের তৃষ্ণার্ত রেখে কষ্ট দেয়ার জন্য, তার উদ্দেশ্য আমাদের ও আমাদের পরিবারের শিশুদের হত্যা করা, আমাদের পশুর পালকে পানি বিনে মেরে ফেলা শিশু আর পশুরা কতদিন পানি ছাড়া থাকতে পারবে, আর আমরাই বা পানি ছাড়া কতদিন বাঁচবো? মূসা বুঝতে পারছিলেন, এই বিক্ষুব্ধ লোকেরা তাকে পাথর মেরে হত্যা করবে- মূসা আল্লাহর দরবারে দু'হাত তুলে কাঁদতে লাগলেন আল্লাহর তরফ থেকে গায়েবী আওয়াজ এলো- হে মূসা তুমি ঐ পাথরে আঘাত কর। মূসা সেই নির্দিষ্ট পাথরে আঘাত করতেই পানি প্রবাহিত হতে লাগলো। তার সাথের লোকেরা বিস্ময়করভাবে লক্ষ্য করলো মরুভূমিতে পানি প্রবাহ শুরু হয়েছে। তারা আনন্দে নেচে উঠলো- এখন আর তাদের কোনো দুঃখ নেই, এই মরুভূমিই তাদের জন্য সব চেয়ে সুখকর স্থান হবে- কারণ তারা পানি পেয়েছে, মিসরের দাসত্ব থেকে মুক্তি পেয়েছেএবং প্রতিশ্রুত ভূমি পেয়েছে। এখন এখানে বাগান হবে- মৌমাছির গুঞ্জন শোনা যাবে। মধু আর দুধে ভরে যাবে- এ অঞ্চল। সবাই সুপেয় পানি পাবে।
মরুভূমিতে পানি পাওয়ার পর সেখানে কিন্তু তারা অলসভাবে বসবাস করেনি সেখানে একটি নগর গড়ে তুললো। তারা অসাধারণ সুন্দর সুন্দর অট্টালিকা তৈরি এবং অবকাঠামোর মাধ্যমে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করলো। কিন্তু এতেও তাদের শান্তি ছিলো না। পানির সমস্যা সাময়িকভাবে না থাকলেও তাদের মনের ভিতর এই সমস্যা সব সময় ছিলো যে কোন সময় কোন জঙ্গী গোষ্ঠী তাদের এই নগর দখল করে নেয়। নদীর পাড়ে এবং সমুদ্রের ধারে নগর তেরি করায় এই সমস্যা ছিল তখন ব্যাপক। নদীতে নৌকা করে বা সমুদ্রের ধারেকাছে থেকে জাহাজে করে বহিরাগতরা ওখানে হানাদার হয়ে প্রবেশ করতো, চলতো লুটপাট, হত্যা, শেষ পর্যন্ত দখল করে নেয়া। সমুদ্রের তীরে যারা বসতি গড়ে তুলতো, তারা সমুদ্রের পানি পান করতে পারতো না। এ জন্য অন্য জায়গা থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হতো সেটাও সহজলভ্য ছিল না- যারা ঐ সুপেয় পানির ধারে থাকতো তারা মনে করতো বাইরের লোক পানি নিলে এ পানি ফুরিয়ে যাবে।
মানুষের প্রথম খাল কাটার ইতিহাস সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য জানা যায় না। তবে যতটুকু জানা যায় তাতে দেখা গেছে মানুষ প্রাচীনকালে খাল কাটতো চক্রকারে। মরুভূমির মধ্যে সোজাসুজি খাল কাটার কোনো সুযোগও ছিল না উত্তর আফ্রিকায়। পারশ্যে প্রথম এই ধরনের খাল কাটা হয়েছিল বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন। চক্রাকারে খাল কাটার কারণ ছিল মরুভূমির মধ্যে পানি পাওয়ায় ক্ষীণ সম্ভাবনা থেকে, কারণ মরুভূমির মাটির নিচে পানির স্তর স্বাভাবিকভাবেই অন্যান্য জায়গার তুলনায় নিচে ছিল-তাই তারা চক্রাকারে খাল কেটে দু'এক মাইল দূরে পাহাড়ের কাছে নিয়ে যেত সেখানে পানি পাওয়া গেলে রোমানরা হাম্মামখানা তৈরি করেছিল। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সেখানে সাধারণ মানুষও গোসল করতে পারতো এবং সজিব হয়ে তাদের কর্মক্ষেত্রে ফিরে যেতো। এ জন্য তাদের প্রচুর পরিমাণে বিশুদ্ধ পানির দরকার ছিল। রোমে প্রাচীনকাল থেকেই সহজ পন্থায় পানি প্রাপ্তির একটি সুন্দর ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। প্যালেস্টাইনে রাজা সালমান এই ব্যবস্থা করেছিলেন। বিশেষ করে জেরুসালেম নগরীতে প্রাচীনকালে পানি প্রাপ্তির এই ব্যবস্থাটি এখনো ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে সিন্ধু নদীর তীরে যে সভ্যতা গড়ে উঠে, সেই সভ্যতার অধিভুক্ত জায়গাটি এখন পাকিস্তান নামে পরিচিত। প্রাচীনকালে সিন্ধুর তীরবাসী মানুষদের জন্য পুকুর, সুইমিংপুল এবং হাম্মামখানা গড়ে তোলা হয়েছিল। শুধু তাই নয় তখন এখানে প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই, বর্তমানে আমরা যেভাবে বাথরুম তৈরি করি ঠিক সেই আদলে সাওয়ার তৈরি করা হয়েছিল। কোনো কোনো বাড়িতে বাথটবের মতো বৃহৎ জারও বানিয়েছিল ধনাঢ্য ব্যক্তিরা। রাস্তার নিচ দিয়ে বিশেষ কায়দায় পানি প্রবাহের ব্যবস্থাও ছিল ঐ সময় পানি সরবরাহের ব্যবস্থা তখন নির্ভলশীল ছিলো-দক্ষতা, ইচ্ছা এবং সম্মিলিতভাবে কাজ করার উপর। এ জন্য দক্ষ-জনশক্তির প্রয়োজনে রোমে দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার এবং ক্রীতদাসদের শ্রমশক্তি নিয়োগ করেছিল। রোম চতুর্থ শতাব্দীতে জার্মানদের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে তাদের এই সুন্দর পানির সরবরাহ ব্যবস্থাটি হারিয়ে ফেলে। জার্মানরা যদিও এই সুন্দর পদ্ধতিটি তাদের দেশের জন্য উপযোগী মনে করতেন কিন্তু রোমে ঐগুলো ধ্বংস করে দিতে তাদের একটুও মায়া হয়নি। যদিও রোমানদের পানি সরবরাহ পদ্ধতিটি ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে কিন্তু এর পূনঃনির্মাণের কোনো উদ্যোগ জার্মান আক্রমণকারীরা চলে যাওয়ার পর আর নেয়া হয়নি। অবশ্য ইউরোপীয়রা মধ্যযুগে এর সংস্কার সাধন করে এগুলো ব্যবহার উপযোগী করেছিল কিন্তু ইউরোপীয়দের সঙ্গে রোমান সভ্যতার মিল না থাকায়-এগুলো স্থায়িত্ব লাভ করেনি। রোমানরা শুধু পানি সরবরাহ করেই ক্ষান্ত ছিল না তারা পানির বিশুদ্ধতা এবং সুষ্ঠু ব্যবহারের প্রতিও তৎপর ছিল। তারা ঈশ্বরের জন্য সম্মিলিতভাবে যেমন গীর্জা নির্মাণ করতো, শহরে পানি সরবরাহের ক্ষেত্রে তাদের সেই সম্মিলিত শক্তির সমাবেশ করেছিল। গীর্জা নির্মাণের মতো পানির প্রবাহ সহজলভ্য এবং সর্বসাধারণের প্রাপ্তির বিষয়টি তারা পবিত্র কর্তব্য হিসেবে বিবেচনা করতো। স্বাস্থ্য সচেতনার ব্যাপারে তারা ছিল সজাগ কোন কূপের পানি ব্যবহারের পূর্বে ঐ পানি ব্যবহারের উপযোগী কিনা-তা অবশ্যই তারা যাচাই করে নিতো।
পানি নিয়ে একটা প্রাচীন সংগীত আছে। গানের কথাগুলো এ রকম-‘কূপ না শুকালে পানি অবশ্যই পাবে।' এই কথাগুলো আজকের দিনেও প্রযোজ্য। আমরা পানির কলের চাবি ঘুরালেই পানি পাই। এ ব্যাপারে আমাদের দু'বার ভাবতে হয় না। একথায় কি আমাদের মাথায় এ ধরনের ভাবনা এসেছে যে, কোন এক সকালে শতবার কলের মুখ ঘুরিয়েও আমরা পানি নাও পেতে পারি। হ্যা এ রকম হয়েছিল বাটার ফিল্ড ফ্যামিলিতে, নিউইয়র্কের হাম্পশায়ারে ঘটেছিল ঘটনাটা। পাহাড় থেকে পাইপ দিয়ে হাম্পশায়ার শহরে পানি আনার যে ব্যবস্থা করা হয়েছিল সেটা অকেজো হয়ে গিয়েছিল। এর কারণ আর কিছুই নয়-ঐ সময় তাপমাত্রা কমে শূন্যের নিচে তেইশ ডিগ্রিতে চলে গিয়েছিল, ফলে পানি জমে বরফ আর পাইপের পানি বন্ধ। ঐ সময়ের দুর্যোগের চিত্র অবর্ণনীয়। বরফ পরিষ্কার করায় আগে ওখানে খাবার পানিও জুটেনি। তাদের হাত মুখ ধুয়া বন্ধ ছিল, কাপড় কাচা বন্ধ ছিল, গোসল এবং রান্নাবান্না করার পানি তো ছিলই না।
বাটারফিল্ড ফ্যামিলি তখন বিপদে পড়ে-দীর্ঘদিন পর তাদের কাজিনের বাড়িতে বেড়াতে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়, আর তল্পিতল্পা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। এর আগে অবশ্য নিউইয়র্কে একটা টেলিগ্রাম করে দিয়েছিল কিন্তু সেখানে গিয়েও একই অবস্থা। তাদের কাজিনের এ্যাপার্টমেন্ট ছিল ষোলতলায়-সেখানে স্বাভাবিকভাবে পানি পাওয়ার কোনো জো ছিল না। পানি পাম্পের সাহায্যে ট্রাকে তোলা হতো তারপর সাপ্লাই হতো বিভিন্ন ভাটায়। বাটারফিল্ড ফ্যামিলি সেখানে গিয়ে দেখলেন পানি তোলার পাম্পটি কাজ করছে না। ফলে কিচেনে গিয়ে পানির কলের হাতল ঘুরিয়ে তাদের ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসতে হলো। এমন যে অবস্থা হবে কে জানতো> বাটারফিল্ড ফ্যামিলি মনে করলো মনের দুঃখে চলে এসেও শান্তি নেই- নিউইয়র্কে এসেও পানি নেই, পানির পাইপ নতুনভাবে সংযোজন করা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু কবে পানি পাওয়া যাবে এটা অনিশ্চিত। বৃষ্টির পানি ধরে রেখে পানি সমস্যার সমাধান হতে পারে বলে যারা বলে থাকেন, পানি জমে বরফ হওয়ার পর তারা আর কোনো কথা বলছেন না। কল টিপতেই পানি আসে এটা কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর আরববাসীরা প্রথম জানলো-তারা যখন ফ্রান্সে শান্তি সম্মেলনে যোগদান করতে এসেছিল তখন দেখলো ছোট একটা হাতল ঘুরালেই পানি আসে-এটা ছিলো তাদের কাছে যাদু শক্তির মতো। আরবদেশে পানি প্রাপ্তির এই ব্যবস্থাটি তারা গড়ে তুলতে চেয়েছিলো কিন্তু তার জন্য যে প্রযুক্তির প্রয়োজন তা তাদের জানা ছিলো না। এই ঘটনা অবশ্য খুব বেশিদিনের আগের নয়, কিন্তু এটা পানি প্রাপ্তির জন্য এমন একটি শিক্ষণীয় ঘটনা যা পরবর্তী সমযে তাদের প্রতিটি বাড়িতে সহজে পানি প্রাপ্তির নিশ্চয়তা দানে সহায়তা করেছে।
নুম আলস্কাসে যারা বাস করেন তাদের পুরো শীতকালটাই এ অবস্থায় কাটাতে হয়। অতিরিক্ত ঠান্ডায় পানি জমে যাওয়ার দরুন বাইরে থেকে গ্যালন গ্যালন পানি কিনে আনতে হয়। নুমআলস্কাসে শীতকাল হলো সেপ্টেম্বরের মধ্যভাগ পর্যন্ত। বাটারফিল্ড ফ্যামিলি এটা জানতো না। তাই নিজের ঘর বাড়ি ছেড়ে এসেও দুর্ভোগ কমেনি। এস্কিমোদের কিন্তু এ সমস্যা পোহাতে হয় না। তারা বরফের রাজ্যে বসবাস করলেও বরফ থেকেই তারা পানি পেয়ে থাকে। এখানে যেমন ইচ্ছে মতো বিশুদ্ধ পানি পাওয়া যায়, তেমনি ভাসমান সামুদ্রিক বরফদন্ড থেকে তারা গৃহস্থালি কাজে পানি সংগ্রহ করতে পারে-যদিও এর মধ্যে লবণাক্ততা থাকে তবে এগুলো খাবার পানি ছাড়া অন্য কাজে ব্যবহারে তেমন অসুবিধা হয় না। অন্যভাবে বিষয়টি দেখা যায় এইভাবে, যদি কেউ এর বিপরীত জায়গা অর্থাৎ মরু এলাকায় বাস করে যেমন মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশে। তা হলে ওখানকার সমাধান দৃশ্য হচ্ছে গাধা বা উটের পিঠে, মশকে করে পানি বহনের দৃশ্য। মিসরে নীলনদ থেকে এভাবে মশকে পানি বহন করে নিয়ে যাওয়া এবং রাস্তায় বিক্রি করা, ওখানকার নিত্যদিনের ঘটনা। বর্তমানে অবশ্য এই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে।
পার্সিয়ান গালফে এক সময় বিশুদ্ধ পানি পাওয়া কঠিন ছিলো, কারণ কূপ খনন করে যে পানি পাওয়া যেতো, তা ছিলো কালচে এবং লবণাক্ত, ওখানে একমাত্র বিশুদ্ধ পানি প্রাপ্তির উৎস ছিলো নিম্নাঞ্চল। বাহরাইনে নিম্নাঞ্চল থেকে সারাদেশে পান সরবরাহ করা হতো। অনেক সময় পানি বিক্রেতারা বসন্তকালে ছাগলের চামড়ার থলিতে পানি ভরে রাখতো আর ঐগুলো শহরে বিক্রি করতো। বর্তমানে বাহরাইনে পানিকে লবণমুক্ত করার জন্য আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে, কিন্তু তাতে স্বস্তি নেই, গভীর নলকূপ থেকে ক্রমাগত পানি উত্তোলন করার ফলে আবার পানির চাহিদা পূরণের জন্য নিম্নাঞ্চলের পানির দিকে হাত বাড়াতে হচ্ছে।
খুব বেশিদিনের কথা নয়, ইরানের তেহরানের রাস্তাগুলোকে এক সময় পানি দিয়ে ধুয়ে দেয়া হতো। এখনো ধুয়ে দেয়া হয় কিন্তু দূরবর্তী পাহাড় থেকে পাইপ দিয়ে যে পানি রাস্তা পরিষ্কারের জন্য আনা হয় রাস্তায় এসে পড়ার আগেই তা নোংরা হয়ে যায়, কারণ ঐ পানিতে লোকেরা গোসল করে, জামা কাপড় কাচে আর ময়লা ও সাবানের ফেনাযুক্ত পানি রাস্তায় প্রবাহিত হয়। তেহরানের বাসিন্দারা কমলালেবুর জুস খেয়ে ওর কৌটা পানিতে ফেলে দেয়। পাইপ থেকে পানি শহরে ঢোকার আগে ঢোকে কংক্রিটের খালে আর ঐ পানি নোংরা করে ওখানকারই একদল অবিবেচক মানুষ। একমাত্র দরিদ্র শ্রেণীর মানুষ ছাড়া ঐ পানি আর কেউ পান করে না। ১৯৫৭ সালে প্রচন্ড খরার সময়-বিত্তবান লোকেরা পানি কিনে খেতো আর দরিদ্রলোকদের বাধ্য হয়ে পান করতে হতো পানের অযোগ্য পানি।
এতেও কিন্তু তাদের ক্ষোভ ছিলো না, ভাল হোক মন্দ হোক পানি পাচ্ছে এটাকেই তারা তাদের নিয়তি ধরে নিয়েছিলো। তারা বলতো আমাদের প্রচুর পানি প্রয়োজন, নিজেদের গৃহস্থালী কাজের জন্য আর কৃষি কাজের জন্য, কিন্তু আমরা তো দেখতেই পাচ্ছি; সর্বত্রই পানির অভাব।
এভাবেই পানির কষ্ট নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে মানুষ বসবাস করছে। দক্ষিণ পূর্ব আফ্রিকায় ক্ষুদ্র একদল উপজাতি এখনো কূপ খনন করে পানির চাহিদা পূরণ করে থাকে। এ জন্য যে কোনো ধরনের মেহনত করতে তারা প্রস্তুত। এমন কি মরুভূমি খুঁড়ে যদি পানি পাওয়া যায়, তা হলেও তারা সেই পানি প্রাপ্তির জন্য নিজেদের নিয়োজিত করতে রাজি আছে।
এশিয়ায় আবার এই চিত্র ভিন্ন। এশিয়ার অধিকাংশ অঞ্চলেই প্রচুর পানি পাওয়া যায়, কিন্তু এতেও কোনো কোনো জায়গায় কিন্তু চাহিদা মিটে না- নেপালের তোসি বাজার এলাকার মানুষকে পাহাড় থেকে পানি এনে তাদের বাড়তি চাহিদা পূরণ করতে হয়। নেপালের জনগণ হিমালয় পর্বতের পাশে থাকে বলে দু'একটি এলাকা ছাড়া তাদের পানির জন্য পেরেশানি নেই, বৃষ্টি হলেই হিমালয়ের ঢলে গ্রামের চারিদিকে পানি থৈ থৈ করতে থাকে, এখানে শস্যও হয় প্রচুর। ভারতের টিগরা গ্রামের চিত্র আবার অন্য রকম-এখানকার মানুষের মুখে হাসি ফোটে বৃষ্টি এলে, বৃষ্টি না হলে ফলন হয় না, আর ফলন না হলে গম ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে হা-হুতাশ করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না।
মানুষ অনাহার আর ভয়ের মধ্যে জীবন কাটায় তাদের মাটির তৈরি কুটির প্রবল বৃষ্টিতে ভেসে যায়, তাই বৃষ্টি আর বর্ষার পর আবার তাদের কুটির তৈরি করতে হয়-তখন রোদ থাকে কড়া আর সদ্য বর্ষার হাত থেকে মুক্তি পাওয়া মানুষজনেরা থাকে দুর্বল। আবার অনাহার, আবার ভয়, এভাবেই তাদের জীবন কাটাতে হয়। কূয়া এবং ঝর্ণা থেকে পানি সংগ্রহ করেই আদিম মানুষেরা, তাদের পানির প্রয়োজন মিটাতো, কিন্তু এখনো যে কূয়া এবং ঝর্ণা থেকে পানি সংগ্রহ করা হয় না তা কিন্তু নয়। গ্রামে বা ছোট শহরে যারা বাস করে তাদের পানির উৎস এখনো কূয়া বা খাল। তবে কূয়া গ্রামের মধ্যে থাকলেও ঝর্ণা কিন্তু গ্রামের ভিতর নেই-যাদের গ্রামের কাছে নদী নেই তারা পানি সংগ্রহের জন্য যায় পাহাড়ে ঝর্ণার ধারে। গ্রাম থেকে অনেক দূর পথ তাদের পায়ে হেঁটে যেতে হয়। কূয়া না থাকলে নিজেরাই কূয়া তৈরি করে নেয়। পানি তোলার জন্য কপিকলও নিজের হাতে তৈরি করে। তারপর যত ইচ্ছা পানি তোলে। কূয়া খুঁড়লেই যে সহজে পানি পাওয়া যাবে-এমন ভাবা ঠিক নয়। কারণ ভূগর্ভের সব জায়গায় পানির স্তর সমান নয়, কোনো জায়গায় পরিমাণ মতো খুঁড়লেই পানি পাওয়া যায় কিন্তু কোনো কোনো জায়গায় পানির স্তর থাকে অনেক নিচে। দক্ষিণ আফ্রিকার কোনো কোনো অঞ্চলে পানির স্তর এত নিচে থাকে যে, সেখানে মাটি খুঁড়ে পানি পাওয়া যায় না। তাই বাধ্য হয়ে পাথরের স্তর ভেঙে পানির খোঁজ করতে হয়। শাবল দিয়ে পাথর ভাঙ্গা সম্ভব না বিধায়, সেখানে ড্রিল মেশিন ব্যবহার করার প্রয়োজন পড়ে। কোনো কোনো সময় দেখা যায় যে, পাথরের ভিতর দিয়ে যে পানির ধারা প্রবাহিত হচ্ছে তা এত সরু জায়গা এবং দ্রুত বেগে যাচ্ছে যে, এ থেকে পানি তোলা সম্ভব নয় কিন্তু যখন ঐ সরু ধারার পানি কোনোভাবে উপরের স্তর ভেঙ্গে ফেলার দরুন বা ফুটো হয়ে যাওয়ার কারণে উপরে উঠার সুযোগ পায় তখন এত দ্রুত উপরের দিকে ধাবিত হয় যে, মনে হয়- পাইপ দিয়ে ঐ পানি উপর দিকে ছুড়ে মারা হচ্ছে। পানি যখন এরূপভাবে প্রবাহিত হয় তখন তাকে বলা হয় আস্টশিন।
হ্যা এই ধরনের কূপগুলোতে তীর বেগে পানি উপরের দিকে ছুটে আসে, আর কোনো সময়ই পানির অভাব হয় না। অবশ্য কোনো কোনো একটি জায়গায় ড্রিল করে পাথর ভেঙ্গে পানি তুলতেই হবে, ঐ দেশের সকল স্থানেই এরূপ ব্যবস্থা করতে হবে, এরূপ কিন্তু নয়। প্রাচীনকালে যে সব কূপে পাথর ভেঙ্গে অথবা ছিদ্র করে পানি বের করা হতো, সেগুলোতে কাঠের ব্যবহার হতো বলে জানা যায়। পরবর্তী সময় প্লাস্টিক পাইপ, ধাতব পাইপও ব্যবহার করা হয়। এই সব কূপের পানিতে প্রচুর পরিমাণ মিনারেল থাকে-অধিক পরিমাণ মিনারেলযুক্ত পানি কিন্তু সব সময় সুস্বাদু হয় না, এমন কি এগুলো অনেক সময় পানের অযোগ্যও হয়ে পড়ে, তবে পরিমিত মিনারেল থাকলে সেই পানির স্বাদ সত্যিকারভাবেই সকলকে আকৃষ্ট করে থাকে।
ধরা যাক, কেউ তার জমিতে কূপ খনন করলো এবং প্রচুর পরিমাণ পানিও কূপে পাওয়া গেল, কিন্তু সমস্যা দেখা দেয়ে এই পানি কিভাবে ব্যবহারের জন্য উপরে তোলা হবে? এই রকম যখন ভাবছে তারা তখন হঠাৎ করে মাথায় বুদ্ধি এলো বালতি বা চামড়ার থলি দিয়ে কূপ থেকে পানি তোলা যেতে পারে যেই অভাব সেই কাজ। আজো অনেক জায়গায় এ ভাবেই পানি তোলার কাজ চলছে। বাঁশ পোঁতে পানি তোলা প্রাচীন পদ্ধতিগুলোর মধ্যে একটি-এটা হলো-একটা শক্ত মতো বাঁশ পোঁতে, পনের বা বিশ ফুট উপরে আর একটি বাঁশ বাঁধতে হবে যাতে এর গোড়াটা মানুষের নাগালের মধ্যে থাকে, আর আগাটা রাখতে হবে উপরে-এই আগায় রশির সাথে বালতি বেঁধে কূয়ায় নামিয়ে গোড়াতে চাপ দিলেই বালতি সমেত পানি উপরে উঠে আসবে। এই পানি তোলার জন্য কোনো কোনো জায়গায় বাঁশের তীরাকৃর্তি বাঁকানো হাতলে গোড়ার দিকে ইট বা পাথর বেঁধে রাখার প্রচলনও আছে। খাল কেটে পানি আনা যেখানে সম্ভব ছিল না সেখানে মশক বা বালতি ভরে পানি আনা হতো। প্রাচীন মিসরীয়রা নীলনদ থেকে তাদের দূরবর্তী গ্রামগুলোতে এভাবেই পানি বহন করে নিয়ে যেতো। পানি বহনের কাজে কোনো কোনো স্থানে উট বা গাধা ব্যবহার করা হতো। আমরা বর্তমানে যে ধরনের কূয়া দেখি প্রাচীনকালে কিন্তু এই ধরনের কূপ ছিলো না। ঐ কূপগুলোর মূল ছিলো প্রশস্ত এবং কূপে পাথরের সিড়ি তৈরি করা হতো এটা সাধারণভাবে আমরা পুস্কুনির সিড়ির মতো ধরে নিতে পারি, এই সিড়িগুলো ছিলো পাথরের তৈরি। একটি লোক সিড়ি বেয়ে বালতি বা জালা নিয়ে নিচে নেমে যেতো আর পানি ভর্তি ঐভাবেই সে কদম কদম করে উপরে চলে আসতো।
বাইবেলে এই ধরনের কূপকে ‘পুল' বলা হয়েছে। সম্প্রতি যে পুলটি আবিষ্কার হয়েছে তার নাম ‘পুল অব গিবন'-এতে ঘন ও মজবুত পাথরের সিড়ি রয়েছে। ষাটের দশকে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার পক্ষ থেকে মরুভূমি এবং দূরবর্তী গ্রামগুলোতে পাইপ লাইনের মাধ্যমে পানি সরবরাহের প্রস্তাব দেয়া হয়, এতে বলা হয় যদি প্রতিটি বাড়িতে সুষ্ঠুভাবে পানি পৌঁছে দেয়া যায়, তা হলে গ্রামের মহিলারা পানি নিতে এসে কূয়ার পাড়ে দাঁড়িয়ে গল্পগুজব করে সময় কাটার সে সুযোগ থাকবে না। স্বাভাবিকভাবেই তারা গৃহকর্মের প্রতি অধিক মনোযোগী হতে পারবে।
গভীর কূপ থেকে পাম্প করে পানি তুলে গৃহস্থের বাড়িতে পৌঁছে দেযার কারণে পানি প্র্রাপ্যতা এখন সহজতর হয়েছে। এই কাজে ব্যবহার হচ্ছে পানি তোলার মটর আর ফায়ার ইঞ্জিন। কোনো কোনো জায়গায় যেখানে প্রবল বাতাস প্রবাহিত হয় সেখানে বাতাসের সাহায্যে চাকা ঘুরিয়ে পানি তোলার কাজ চলছে। এসব হয় যেখানে অনুকূল বাতাস আছে সেখানে কিন্তু যেখানে বাতাস নাই সেখানে বিদ্যুৎ বা গ্যাস ব্যবহার করে পানি তোলার কাজটি সহজে করা যায়।
হ্যাম্পসশায়ার-এর পার্শ্ববর্তী কোনো কোনো জায়গায় গভীর নলকূপ থেকে পানি তোলার পরিবর্তে ছোট নদী বা খাল থেকে পানি আনা হয়। যেখানে ঐ ধরনের সুযোগ নেই, সেখানে গভীর কূপ খননের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। এই গভীর কূপ কিন্তু সাধারণ কূয়ার মতো নয়-অনেকটা ছোট দিঘির মতো এর মধ্যে সিমেন্ট বা পাথরের সিঁড়ি থাকে এ সিঁড়িগুলো দিয়ে অনায়াসে পানির কাছে নেমে আসা যায়-আবার কোনো কারণে কূপ ঢেকে রাখার প্রয়োজন হলে উপর থেকে ঢেকে রাখাও যায়। কোনো কোনো বাড়িতে বিল্ডিংয়ের নিচে জলাধার তেরি করা হয়-এ থেকে গৃহস্থালীর জন্য যত পানির প্রয়োজন ব্যবহার করা যায়, এমন কি ঐ পানি পার্শ্ববর্তী বাড়িতে বা এলাকায় সরবরাহের ব্যবস্থাও করা হয়ে থাকে এ জন্য অবশ্য পানির মালিককে প্রয়োজনীয় অর্থ দিতে হয়। আবার কোনো কোনো বাড়িতে পাথর বা সিমেন্টের জলাধার তৈরি করে পাহাড় থেকে পানি এসে ঐ জলাধার ভর্তি করে রাখা হয়। অবশ্য এটা শুষ্ক মওসুমের জন্য যখন বর্ষাকাল আসে তখন এগুলোর বালাই থাকে না তখন তো সর্বত্রই জল আর জল। এটা তো গ্রাম্য এলাকার জন্য, শহর এলাকায় বর্ষা হলেই কি সব জায়গায় পানি মিলে আর মিললেও কি সেগুলো ব্যবহারের উপযুক্ত?
প্রাচীনকালে কোনো জায়গার মাটি সামান্য খুঁড়লেই জলের সন্ধান পাওয়া যাবে-এ জন্য একদল লোক ছিলো এদেরকে বলা হতো ডাউচিং।
ডাউচিং যারা করতো তাদের ভূঅভ্যন্তরে কোথায় পানি আছে এটা বলার ক্ষমতা ছিলো-অনেকটা জ্যোতিষীদের মতো তারা বাঁশের লাঠি বা কাঠের দন্ড দিয়ে মেপে মেপে মাটির উপরে একটি জায়গায় গিয়ে খুটি গেড়ে বলতেন এখানে পানি আছে এবং খুঁড়ে সেখানে পানি পাওয়া যেতো।
এটা কিভাবে সম্ভব ছিল তা অবশ্য জানা যায়নি তবে আধুনিক বিজ্ঞান বলে তারা হয়তো তাদের এই পানি সন্ধানে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিই প্রয়োগ করতো। তারা নিকটবর্তী জলাশয় বা নদীর পানির লেবেল এবং মাটির নমুনা দেখে নদী থেকে দূরবর্তী স্থানে পানি পাওয়া আন্দাজ করে নিতে পারতো। ১৯৫৬ সালে ডাউচিংদের প্রাপ্ত একটি ক্যাটালগ থেকে বুঝা যায়-কূপ খোড়ে পানি প্রাপ্তির ব্যাপারে তারা বিবিধ পন্থা অনুসরণ করতো। এর মধ্যে যেখানে পানি প্রাপ্তির জন্য কূপ খনন করা হচ্ছে, সেখান থেকে নার্সারী বা কোনো সবুজ গাছপালা বেষ্টিত বাগান কতদূরে আছে- ওখানে কি শুধু চারাগাছ না মহীরুহও আছে-এর পর কাছাকাছি এর আগে কোথাও কূপ খনন করা হয়েছিলো কি না? আর করে থাকলে ঐ কূপে পানি পাওয়া গিয়েছিলো কিনা এ সবই তারা বিবেচনায় রেখে নতুন কূপ খনন করতো আর নিশ্চিতভাবে পানি পেয়ে যেতো।
৮.
প্রতিদিনই তো মানুষের পানির প্রয়োজন, বিশেষ করে গোছলের জন্য। একটি মানুষের যদি প্রতিদিন ব্যবহারের জন্য ৩০ গ্যালন পানি লাগে তা হলে ১০০ কোটি গ্যালন পানি দিয়ে শুধু সে প্রতিদিন গোছল করতে পারবে ৯১,০০০ বছর। এই হিসাবেই নিউইয়র্ক সিটিতে প্রতিদিন পানি ব্যবহার হচ্ছে। কিন্তু মাত্র ১০০ বছরের আগের চিত্রও কিন্তু এর ধারে কাছে ছিলো না। মাত্র কয়েক গ্যালন পানিই একজন মানুষের জন্য যথেষ্ট মনে করা হতো। এখন আমেরিকার প্রতিটি বড় শহরেই জনপ্রতি ১৪৬ গ্যালন পানি ব্যবহার করা হয়। ছোট শহরে প্রতিটি মানুষের জন্য পানি বরাদ্দ আছে মাত্র ৬০ গ্যালন। কোনো ফ্যামিলিতে যদি লোকজন বেশি থাকে তা হলে চুরি করে পানি সংগ্রহ করে তাদের প্রয়োজন মিটানো হয়ে থাকে।
ছোট এবং বড় শহরের মধ্যে পানি ব্যবহারের এই বৈষম্য কেন? কারণ যারা ছোট শহরে বাস করে তারা পানির কদর বুঝে- বৃহৎ নগরবাসীর মতো অকারণে তারা ড্রেন ভর্তি করে ফেলে না। বড় শহরে অধিক পানি ব্যবহারের আরো একটি কারণ আছে-এখানে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণে এবং কারখানাগুলোতে প্রচুর পানি ব্যবহৃত হয়। এ কারণেই বড় শহরগুলোতে প্রতিটি মানুষের গড় পানি ব্যবহারের হার এত অধিক। এই পরিসংখ্যান থেকে কিন্তু জানার ওপর নেই-আসলেই প্রতিটি মানুষ বৃহৎ নগরসমূহে কি পরিমাণ পানি ব্যবহার করে- এখানেও হয়তো লোকের সংখ্যা কম নয়- যারা ছোট শহরের বাসিন্দাদের চেয়েও কম পানি ব্যবহার করে। ত্রিশ গ্যালন পানির দাম কত? খুব বেশি নয় ষাটের দশকে এই পানির মূল্য ছিলো মাত্র এক পেনি। অনেক শহরে পানি সরবরাহ করা হয় নিকটবর্তী পাহাড় থেকে এ কথা আসেই বলা হয়েছে। নদী এবং হৃদ থেকেও পানি এনে শহরের পানির প্রয়োজনীয়তা মিটান হয়। যারা মিসিসিপির তীরবর্তী শহরে বাস করে তাদের পানির নলে যে মিসিসিপির পানি প্রবাহিত হয় এটা ঐ শহরের সবাই জানে না। অথচ মিসিসিপির তীরে দাঁড়িয়ে যদি কেউ এর খোলা জলের দিকে তাকায় তা হলে ঐ পানি পান করা তো দূরের কথা কাপড় চোপড়ও ধুতে চাইবে না-কিন্তু শহরে প্রবেশের আগেই এই পানি পরিপূর্ণ রূপে বিশুদ্ধ ও স্বচ্ছ হয়ে যায়।
পেনশিলভিনিয়ার মানুষ নদী থেকে পানি সংগ্রহ করে তারা আধুনিক পানি বিশুদ্ধকরণ যন্ত্র ব্যবহার করে শহরে পানির চাহিদা মিটায়।
প্রত্যেক বড় শহরের পাশেই নদী থাকার দরুন শহরবাসীরা নদী থেকে সংগ্রহিত পানি বিশুদ্ধ করে ব্যবহার করে ঠিকই কিন্তু যদি অন্য কোনো পানির উৎস থেকে পানি প্রাপ্তির সম্ভাবনা থাকতো এই শতাব্দীর শুরুতে লস এঞ্জেলস-এর লোক মানুষই ভাবতে পারেনি। নদরীর এই বিপুল পরিমাণ পানির চাহিদা কিভাবে মিটানো হবে? তাদের ধারণা ছিলো শহর থেকে নদীর দূরত্ব অধিক হওয়ায় নদী থেকে বোধ হয় পানি আনা সম্ভব হবে না। এ কারণে ডিপ টিউবওয়েল থেকে যেভাবে পানি সাপ্লাই করা হতো, এতে নগরবাসীর পুরো চাহিদার জোগান হতো না। ফলে তারা পানি কষ্টে পড়েছিলো চরমভাবে, কিভাবে আরো অধিক পানি শহরে আনা যায় এই নিয়ে ভাবনার পেরেশানির অন্তছিলো না। তাদের এই পেরেশানির অবস্থান হলো Sierrk Nevada পর্বতের বরফ গলে যখন ওয়েনস নদী প্লাবিত হয়ে গেলো তখন আর নদী থেকে পানি টেনে নিতে কোনো সমস্যা হলো না। ১৯১৮ সালে নগরীর প্রকৌশলীরা নিশ্চিত হলেন যে, এখন আর শহরের পানি সমস্যা সমাধানে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই ইচ্ছে করলে দীর্ঘদিন ব্যবহারের পানি জমিয়েও রাখা যাবে।
তাদের এই ধারণা ভুল প্রমাণিত হতে বেশিদিন নগরবাসীকে অপেক্ষা করতে হয়নি। ১৯২৮ সালের মধ্যেই নগরে তীব্র পানি সংকট দেখা দিলো। অথচ পানি প্রাপ্তির উৎসগুলো তখনো সক্রিয় ছিলো কিন্তু সরবরাহ করার ব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়ার কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়। এর সাত বছর পর বোলডার ড্যাম তৈরি করা হয়, এখন এর নাম হলো হোবার ড্যাম। এটা নির্মাণ করা হয়েছিলো কালার ডো নদীর ওপর। আরিজনা এবং নিভাদার মাঝখানে সরকার বাঁধটি তৈরি করে দীর্ঘমেয়াদী পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করেন। কোলারডো নদী ছিলো অশান্ত এটা বন্যার সময় আগে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠতো। বাঁধ দেয়ার ফলে পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা হয় ফলে বাঁধকে অপরদিক থেকে সারা বছর প্রয়োজন মতো পানি নগরের যে কোনো জায়গায় সরবরাহের ব্যবস্থা সহজ হয়ে যায়। ঐ পানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি বাড়তি সুবিধা পেয়ে যাওয়ার ফলে বিদ্যুৎ ঘাটতিরও চিন্তা থেকে মুক্তি পায় তারা। লসএঞ্জেলস এবং অন্যান্য শহরে বন্যার পানি জমা রেখে সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়। বাঁধে জমা করা পানি ১৫০ মাইল পেছনে হোডার ড্যামে জমা করা হয়। এরপর এই পানি বিদ্যুৎ চালিত পাম্পের সাহায্যে ১৬১৮ ফুট উঁচু পাহাড়ে নিতে দারুণ কষ্ট পোহাতে হয়েছিলো। ঐ সময় রাস্তাঘাটের অবস্থা খারাপ থাকার দরুন পানি সরবরাহকারী সংস্থাকে স্বাভাবিকভাবেই কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছিলো।
কোলারডো নদীর পানি মাইলের পর মাইল অতিক্রম করে শহরে পৌঁছে দেয়ার জন্য পুরো যাতায়াত ব্যবস্থা, টেলিফোন যোগাযোগ ক্ষেত্রেও তাদের নজর নিতে হয়েছিলো- ঐ সময় কালারডো থেকে লস এঞ্জেলসে টেলিফোন যোগযাযোগও ছিলো না।
রাস্তাঘাট তৈরির পর বিষয়টি সহজ হয়ে যায়। মরুভূমির ওপর দিয়ে শহরে পানি সরবরাহ অতি সহজে সম্পন্ন হয়। একইভাবে বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎতম নগরী নিউইয়র্কেও পানি দেয়ার ব্যবস্থা করে সংশ্লিষ্ট বিভাগ। অথচ গত শতাব্দীর গোড়ার দিকে নিউ ইয়র্কবাসীদের খনন করা কূপের জলের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। রিজার্ভ করে সংরক্ষিত পানি শুধু শহরেই সরবরাহ হয়নি। ক্রমান্বয়ে এটা প্রসারিত হয়ে শহরতলিতে চলে যায়। প্রথম নিউইয়র্কে যে কূলগুলো যখন করা হয়েছিলো-সেগুলোর গভীরতা ছিলো ১১২ ফুট। এগুলোতে সলিড রড দিয়ে নিম্নভাগের গাঁথুনি তৈরি হয়েছিলো। এতে প্রতিদিন ২১০০০ গ্যালন পানি পাওয়া যেতো। শহরের মানুষ কিন্তু পয়সা ছাড়া এই পানি পায়নি। ১৮৪২ সাল পর্যন্ত নিউইয়র্কবাসীকে চড়াদামে পানি ক্রয় করে খরচ করতে হয়েছিলো এরপর যখন ক্রোটেন নদীতে বাঁধ দিয়ে পানি আনা শুরু হয়, তখন এই ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটে। পাথর এবং সিমেন্টের ট্যানেল তৈরি করে নদীর পানি এর মধ্যে প্রবাহিত করা হয়, নদীতে বাঁধ দিয়ে পানি ধরে রাখা আর সরবরাহ করার সাথে সাথে নদী পারাপারের জন্য ব্রিজ নির্মাণের ব্যবস্থা করা হয়েছিলো- ব্রিজটি নির্মাণ হয়েছিলো প্রাচীন রোমের স্থাপত্য অনুসরণ করে। ব্রিজটি এখনো আছে আর মানুষ এর ওপর দিয়ে পায়ে হেঁটে পার হচ্ছে। নিউইয়র্কবাসীরাও জানতো এত বড় শহরে পানি সরবরাহ করা কত ঝামেলার কাজ। এজন্য ইঞ্জিনিয়ারগণ একশ মাইল দূরের কাটাকিল পাহাড় থেকে বিকল্প হিসেবে দ্বিতীয় রিজার্ভার পূর্ণ করার ব্যবস্থা করে রাখেন। এই পাহাড়ে ১২ মাইল দীর্ঘ একটা হৃদ আছে যার নাম আলোকান রিজার্ভার এটা অবশ্য তৈরি করা হয়েছিল। আর এখান থেকেই ট্যানেলের মাধ্যমে পানি আনা হয় নিউইয়র্ক শহরে। কাটাকিল থেকে পানি আনার ব্যবস্থা সচরাচর যেভাবে আনা হয় সেইভাবেই করা হয়েছিলো। কাটাকিল প্রকল্পটি শেষ হয় ১৯১৭ সালে, ঐ সময় বর্তমান প্রযুক্তির ন্যায় উন্নত প্রযুক্তি ছিলো না বলে এতে হাই পাওয়ার্ড মেশিন সংযোজন করা সম্ভব হয়নি। তবে শহরে যখন ট্যানেল দিয়ে পানি আসতে শুরু করলো তখন একটা উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিলো। প্রায় এক হাজার লোক সেস্টলি পার্কে জমায়েত হয়ে উৎসব পালন করেছিলো। রাস্তায় রাস্তায় ছেলেমেয়েরা নেচে গেয়ে উৎসবে শরীক হয়। ঐ দিন আকাশ নির্মল থাকায় আনন্দ মিছিলে যোগদানকারীদের সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিলো। শহরের মেয়র লাউড স্পীকারে উৎসবে যোগদানের জন্য আহবান জানান। দশ হাজার কলেজের ছাত্রী এবং পনের হাজার স্কুলের ছেলেমেয়ে নিয়ে মেয়র শহরে আনন্দ মিছিল করেন। তাদের সবার মুখে মুখে সংগীতের সুর ধ্বনিত হতে থাকে আর সেই সংগীত ছিলো দ্য গুড গিফট অব ওয়াটার। জাতীয় সংগীতের সাথে পানি বন্দনার গান গেয়ে যখন তারা উৎসব পালন করছে এমন সময় হঠাৎ করে আকাশ কালো মেঘে ভরে যায় আর দরদরিয়ে নেমে আসে বৃষ্টি-বৃষ্টির মধ্যেও এই উৎসব মিছিলের আনন্দ প্রকাশে বিঘ্ন ঘটেনি। পানি বন্দনা করতে করতে মিছিলকারীরা পানিতে ভিজে সত্যিকারভাবে পানি প্রাপ্তির আনন্দ অনুভব করে। একদিকে পাহাড় আর নদী থেকে পানি এনে শহরের রিজারডারগুলো পূর্ণ হচ্ছিল আর অন্যদিকে আকাশ থেকে বৃষ্টি পড়ছিলো।
এই সময় বোর্ড অব ওয়াটার সাপ্লাই তাদের পরিকল্পনা কার্যকরী করার দিকে মনোনিবেশ করলো। তারা ডেলওয়ারা নদী থেকে পানি সাপ্লাইয়ের ব্যবস্থা করলো আর পাহাড়ের ঝর্ণা থেকে খাল কেটে স্বচ্ছ আর বিশুদ্ধ পানি শহরের মধ্যে যাতে সাপ্লাই দেয়া যায়, তার আয়োজন করতে লাগলো, কিন্তু এ কাজ করতে গিয়ে তারা সম্মুখীন হলো কঠিন সমস্যার। ডেলওয়ারা নদী শহরটিকে ঘিরে রেখেছে। নিউজার্সি আর পেনসেলভিনিয়ার মধ্যে সীমান্ত রেখা সৃষ্টি করেছে এই নদী। এ কারণে এ নদী থেকে পানি টেনে নেয়ায় আদালতে মামলা উঠলো। শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট এই রায় দিলো যে, নিউইয়র্ক ডেলওয়ারা নদী থেকে তাদের প্রয়োজন মেটাবার জন্য আংশিক পানি নিতে পারবে।
এই রায় যখন প্রকাশিত হয়। ডেলওয়ারা নদী থেকে তুলে আনা পানির রিজারভার তখনো তৈরি হয়নি। সময়টা ১৯৪৯ আর ঐ বছর শুরু হলো প্রচন্ড খরা। এই খরার কাহিনী অবশ্য ভিন্ন প্রসঙ্গ। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে তারা শহরে পানি সরবরাহের জন্য একটা আধুনিক ব্যবস্থার সূত্রপাত করলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে ডেলওয়ারা সিস্টেমে বিঘ্ন ঘটে। পরে ৪টি বৃহৎ রিজারভার নির্মাণ সমাপ্ত হয়। এরপর নিউইয়র্ক সিটিতে পানি সরবরাহের আর কোনো বিঘ্ন থাকবে না বলে মনে করা হয়েছিলো, কিন্তু তখনো নিউইয়র্ক সিটিতে পানির পুরোপুরি পানি সরবরাহ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। পরে দুটো টানেলের মধ্যে দিয়ে পানি প্রবাহের ব্যবস্থা করা হয়। এই টানেল বেশ গভীর করে নির্মাণ করা হয়েছিলো। এর গভীরতা ছিলো দুই মানুষ সমান- একজন মানুষের ঘাড়ে আরেকজন মানুষ দাঁড়ালে প্রবাহমান টানেলের পানিতে তাদের দেখা যেতো না। এ রকমই পাঁচটি টানেল তৈরি করা হয়েছিলো আর এগুলোর পানি গিয়ে জমা হচ্ছিল সেন্ট্রাল পার্কে তৈরি করা একটা জলাধারে প্রকৃতপক্ষে ওটা ছিলো একটা সুইমিং পুল। প্রায় অর্ধমাইল লম্বা এই সুইমিং পুলটি থেকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাইপের মধ্য দিয়ে পানি প্রবাহের ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। কাস্ট আইরন, স্টিল বা অন্য কিছু দিয়ে তৈরি পাইপে পানি প্রবাহ করতে কোনো বিঘ্ন ঘটেনি। বাড়িতে বাড়িতে পানি সরবরাহ প্রথমে নিউইয়র্ক সিটিতে করতে গিয়ে রাস্তার মধ্যে পাইপগুলো যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, এ কথাও তাদের ভাবতে হয়েছে। পানি প্রবাহের পাইপ ক্ষতিগ্রস্ত হলে পানি দূষিত হয়ে যাবে, নিউইয়র্কবাসীদের এ চিন্তা থেকেই পানির নিচ দিয়ে পাইপগুলো টেনে নেয়ার ধারণা মাথায় আসে। তবু শেষ রক্ষা হয়নি। মাটির নিচ দিয়ে টানা পাইপ ফেটে গেছে। পানি প্রবাহ বিস্মিত হয়েছে।
পানি প্রবাহ শহরে বিঘ্নিত হলে শহরের কেন্দ্রস্থলে ঊর্ধ্বমুখী যে ঝর্ণা সৃষ্টি করা হয়েছিলো, ওটি কিন্তু চালু ছিলো। শহরকে দৃষ্টিনন্দন করার জন্য ঐ ঝর্ণার সৃষ্টি করা হয়। এতে গৃহে গৃহে পানি সরবরাহের পাইপের কোনো সংযোগ ছিলো না। তাই ইঞ্জিনিয়ারগণ এতে পানি প্রবাহ বিঘ্ন ঘটার ঝামেলা থেকে মুক্ত ছিলেন।
বাড়ি বাড়ি পানি প্রবাহের জন্য পাইপ দিয়ে যে ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। এগুলোর সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে বা ফেটে গেলে কি ব্যবস্থা নেয়া হয়ে এই কথা তখন তাদের মাথায় আসেনি। ১৯৫৮ সালে নির্বিঘ্নে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়। এর ফলে রাস্তার নিচ দিয়ে লাখ লাখ গ্যালন পানি প্রবাহিত হতে থাকে, শহরবাসীদের পানি ব্যবহারের পরিমাণ আবহাওয়ার ওপর নির্ভরশীল হতো। গ্রীষ্মকালে তারা প্রচুর পরিমাণে পানি ব্যবহার করতেন আর শীতকালে স্বাভাবিকভাবেই তাদের পানি ব্যবহারের পরিমাণ কমে যেতো।
এরপর শহরের মানুষের নিত্য ব্যবহার্য পানির অভাব হয়নি। তারা গরমের দিনে তাদের লনে পানি ছিটিয়ে দিয়েছে। বাগানে পানি দিয়েছে। সাওয়ার ফেলে মনের মতো গোসল করেছে। নিউইয়র্ক সিটির পর অন্যান্য শহরে একই ব্যবস্থা গ্রহণ করেন কর্তৃপক্ষ।
৯.
১৯৪৯ সালে নিউইয়র্ক সিটিতে গ্রীষ্মের কারণে পানি সরবরাহ কমে যায়। অথচ শহরের চার পাশেই নদী থাকায় পানির অভাব ছিলো না। এরপর ছিলো সমুদ্র সেখানকার পানি লবণাক্ত। এই লবণাক্ত পানি কেউ ব্যবহার করতো না। যে পানি রিজারভার থেকে সাপ্লাই করা হতো, লোকেরা শুধু সেই পানিই ব্যবহার করতো। উপরন্তু কয়েক মাস অনাবৃষ্টির দরুন এই সমস্যা আরো প্রখর হয়ে ওঠে।
শহরবাসী কিন্তু এতে ভীত হয়নি। একে তো খরা তার উপর পানির অপচয়। বাড়িতে বাড়িতে রান্না-বান্নার কাজ থকে ডিসওয়াশ করা, বাগানে পানি দেয়া অথবা শিল্প-কারখানায় পানি ব্যবহার তারা আয়ের মতোই চালিয়ে যেতে থাকে। ইঞ্জিনিয়ার পড়েন দুর্ভাবনায়, তারা মধ্য গ্রীস্মে রিজারভার খুলে দেখেন এতে পানির পরিমাণ অর্ধেক হয়ে গেছে। তারা বৃষ্টির আশায় অপেক্ষা করতে থাকেন। নিউইয়র্ককে দ্বিতীয় কোনো রিজারভার ছিলো না। আর এ বছর এমন কাঠফাটা খরা হবে এটাও তারা ভাবতে পারেনি। খরার সময় পাম্প করে ভূগর্ভস্থ পানি তোলাও ছিলো কঠিন। প্রচন্ড গরমের জন্য শহরবাসীরা ১৯৪৮ সালে দিনে দুই থেকে তিনবার গোসল করতো। মিসেস স্মিথ তো প্রতিদিনই কাঁড়ি কাঁড়ি কাপড় ধুতেন। খাবার পর প্লেটগুলো ধৌত করতেন প্রবাহমান পানির ধারায়।
টমি স্মিথেরও পান অপচয়ের অভ্যাস ছিলো তিনি পিপাসা হলে কলের মুখ খোলে রাখতেন আর পড়ার জন্য তার ট্যাবের পানি গরম হয়ে যেতো বলে যতক্ষণ না ঠান্ডা পানি বের হয় ততক্ষণ খাবার পানি সংগ্রহ করতেন না। এভাবে প্রচুর পানি ড্রেন দিয়ে গড়িয়ে যেতো।
পানির এই অপচয় সম্পর্কে স্মিতদ্বয়ের কোনো ধারণাই ছিলো না, তারা মনে করতেন পানি তো অপচয়ের জন্যই যত ইচ্ছা ব্যবহার কর, যত ইচ্ছা ফেলে দাও।
একদিন সকালে সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হলো রিজারভারের সঞ্চিত পানির পরিমাণ তলায় নেমে গেছে। এরপর পানি ব্যবহারের ওপর বেশ কিছু বিধি নিষেধ জারি করা হয় এগুলোর মধ্যে ছিলো কেউ প্রবাহমান পানির মধ্যে তাদের ডিস পরিষ্কার করতে পারবে না। প্রতিদিন কাপড় ধোয়া যাবে না। কেউ বাড়ির সামনে কৃত্রিম ঝর্ণার সৃষ্টি করতে পারবে না এবং রাস্তা পাইপের পানি ছেড়ে দিয়ে ধৌত করা যাবে না।
মিসেস স্মিথ সকাল ৯টায় রেডিও খুলে এই সংবাদটি শুনলেন তার কাছে এর চেয়ে ঐ দিনের জন্য অন্য কোনো সংবাদই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি।
এর পরদিন তিনি শহরের বাইরে শপিং করতে গিয়ে দেখলেন- লোকেরা সেখানে দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার সেঁটে রেখেছে। এর মধ্যে কলের খোলা পাইপ দিয়ে পানি পড়ার ছবি ছিলো আর নিচে লেখা ছিলো স্টপ ওয়াটার ওয়াস্ট, অমিতব্যয়ী হবেন না, পানির প্রতিটি ফোটা রক্ষা করুন। মিসেস স্মিথ পোস্টারের ভাষা পড়ে নিজকে দোষী ভাবতে লাগলেন, কারণ তিনি রান্না ঘরের কলের মুখ সব সময় খোলা রাখেন।
এরপর নিয়মিত রেডিও থেকে পানি ব্যবহার ও অপচয় সম্বলিত নিউজ বুলেটিন প্রচার হতে থাকলো। ডিসেম্বর মাসে সামান্য বৃষ্টি হলো। যে পরিমাণ পানি রিজারভারে আছে তাতে বড়জোর দু'মাস। মানিফেরৎ গাড়ি ধোয়ার ব্যাপারে আর লন্ড্রির মানিফেরৎ কাপড় ধোয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক হলো যাতে পানির ব্যবহার সীমিত হয়। স্মিথ পরিবার যেনতেনভাবে পানি খরচ করার জন্য দশ ডলার জরিমানা দিলেন। একজন স্মিত পরিবারকে পরামর্শ দিলো তার পরিবারের সব সদস্যদের জামার হাতার মধ্যে ‘যেন পানি রক্ষা কর' আর জামার পিছনে ‘অপচয় বন্ধ কর' এই স্টিকার লাগিয়ে দেয়া হয়। একদিন রোববার সকাল বেলায় তাদের গাড়ি নিয়ে পরিবারের সদস্যদের গায়ে পানি রক্ষার স্টিকার লাগিয়ে রিজারভারের কাছে হাজির হলো।
তারা দেখলো রিজারভারের পানি আসতেই কমে গেছে ভিতরে সামান্য পানি আর কাদা। মি. স্মিথ ভাবলেন রিজারভারের বারটা বেজে গেছে, পানিও অপ্রতুল এভাবে চললে তার লন্ড্রী বন্ধ করে দিতে হবে নিত্য কাজকর্মে যে পরিমাণ পানি দরকার তাতেও ঘাড়তি দেখা দিবে।
এর পরের মাসে রেডিওতে পানি নিয়ে নিয়মিত অনুষ্ঠান শুরু হলো। কলের মুখ বন্ধ রাখুন। ভাল পানির কল কিনুন, যেন বন্ধ করার পরও পানি না ঝরে, চুরিয়ে না পড়ে।
স্মিত সব সময় পানি ধরে রান্নার চেষ্টা করতেন, তার আশঙ্কা ছিলো হয়তো এর পর পানি একেবারেই বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে নল দিয়ে আর পানি আসবে না। এরপর লোকদের কূয়া তৈরি করার হুজুগ লেগে গেলো। গাড়ি ধোয়ার পানি, লন্ড্রির পানির প্রয়োজন মেটাতে তাদের এই খুঁড়াখুড়ি।
অনেকে পুরানো কূপ সংস্কার করলো। পানির অভাব না হলে এগুলোতে হয়তো হাত দেয়াই হতো না।
স্যাম স্মিথ আছেন ভীষণ ঝামেলায়। এক সপ্তাহ তার দাড়ি কাটা হয়নি। লম্বা দাড়িতে মুখ ঢেকে গেছে। বুনো বুনো লাগে। মিসেস স্মিথ কোনোভাবে পরিবারের সবার কাপড়-চোপড়গুলো ধৌত করেছেন। তিনি থালা-বাসুনগুলোও এখন পরিষ্কার করেছেন সতর্কতার সাথে কোনোভাবেই যেন অতিরিক্ত পানি খরচ না হয়। ছোট টমি গামলার মধ্যে পানি নিয়ে খেলনা নৌকা ভাসিয়েছে, মিসেস স্মিথ তো দেখে হতবাক। এই পানি এলো কোত্থেকে- তাহলে কি কলে এখন পানি আসে? বিরাট গামলা কয়েক গ্যালন পানি হবে, তিনি খেলনা নৌকাটি ছেলের হাতে দিয়ে পানি ঢেলে রাখেন গ্যালনে। বলা যায় না, একেবারেই যদি পানি না মিলে তা হলে খাবার পানি তো জমিয়ে রাখতে হবে। সুচি আর তার বন্ধুরা মিলে গান করছে আর নাচছে- তারা এই সঙ্গীতটির নাম দিয়েছে ‘কোল ওয়াটার'। মরুভূমিতে মানুষ পানির জন্য যেভাবে চিৎকার করে, ওদের গানের কথাগুলো সেই রকম।
শহরের বাসিন্দারা পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করলো। শিল্পকারখানায় যাতে পানির অপচয় না হয় সে জন্য সবাইকে সজাগ করে দিলো সরকার। প্রকৌশলীরা হিসাব করে দেখলেন যদি জলের অপচয় রোধ করা যায় তা হলে প্রতিদিন ১৯,৬৮,০০,০০০ গ্যালন পানি বেঁচে যাবে। নিউইয়র্কবাসীকে এই জরুরি অবস্থা মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
সব কিছু ভালভাবেই চলছিলো, কিন্তু সবাই ভয়ে ভয়ে ছিলো- পানি বাঁচালেই কি এ ভয়াবহ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে? কারণ শুধু নিউইয়র্ক শহরে নয়, এর আশপাশের অঞ্চলগুলোর অবস্থাও খারাপ। হোটেলগুলোতে পানি সাপ্লাই বন্ধ। বালতিতে করে পানি নিয়ে হোটেলের কাজকর্ম চলছে। বাড়িতে বাড়িতে বালতিতে করে পানি নিয়ে ঢুকছে পুরুষেরা। নিউইয়র্ক এবং ইংল্যান্ডবাসীরা সেদিক দিয়ে ভাগ্যবান। তাদের এখনো বালতি হাতে দূর দূরান্তে যেতে হয় না। যদিও অনেক ঝর্ণা আর কূপ শুকিয়ে গেছে, তারা নতুন কূপ খনন করে বা পুরাতনগুলো পরিষ্কার করে টেনেটুনে পানির চাহিদা মিটাচ্ছে। বাটার ফিল্ডের পরিবার এখন নিউ জামাসশেয়ারে তারা দারুণভাবে জনকষ্টের মোকাবিলা করছে, প্রতিদিন পাহাড় থেকে জল আনতে হয়, তারপর নিত্যকর্ম। এর আগে পাহাড়ের ঝর্ণা থেকে কাঠের পাইপ লাগিয়ে আনার ব্যবস্থা হয়েছিলো। পাইপটি অকেজো হয়ে যাওয়ার পর ঘাড়ে করে জল আনতে হয় আর কখন বৃষ্টি হবে এ জন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। পাহাড় থেকে পানি না আনলে নাওয়া-খাওয়া বন্ধ। কী যে ঝামেলায় আছেন মি. বাটার ফিল্ড।
বাটার ফিল্ড প্রতিদিনই একজন বালককে পাহাড়ে পাঠাতেন- ঐ বালকটির কাজ ছিলো পাহাড়ের ঝর্ণায় পানি প্রবাহিত হচ্ছে কিনা দেখার জন্য? সে একটা শুষ্ক লাঠি নিয়ে যেত আর ঝর্ণার নালা দিয়ে কতটুকু গভীর হয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে ডুবিয়ে চিহ্ন করে নিয়ে আসতো। মি. বাটার ফিল্ড দেখে হতাশ হতেন।
মাঠের শস্য হলুদ হয়ে গেছে, এর শুকনো পাতাগুলো বাতাসে শনশন করছে। উলকপি ফুলকপি সব বিস্বাদ এমন খরা চলছে যে, গরু-মহিষগুলো পানি না পেয়ে কাদায় শুয়ে পড়েছে। এসব সংবাদ শুনে বাটার ফিল্ড আরো ভেঙ্গে পড়লেন।
কলের নলের প্রতি ফোটা পানির সদব্যবহার করার যে প্রতিজ্ঞা তৈরি করেছিলেন, সেভাবেই পানি ব্যবহার করছেন। পাহাড় থেকে ছেলেটি ফিরে এসেছে। লাঠির যেখানে সে নালার মধ্য পানির গভীরতা মেপে চিহ্ন দিয়ে এনেছে, তাতে পানি বাড়ছে। বাটার ফিল্ড আশান্বিত হলেন। অনেকদিন ধরে তিনি পর্যাপ্ত পানির অভাবে গোছল করতে পারছেন না। একটা সাবান নিয়ে লেকের দিকে রওনা হলেন। তার বাড়ি থেকে লেকের দূরত্ব প্রায় একমাইল- এত দূরে কেউ আসে না। তিনি সাবান আর মগ নিয়ে এসে দেখলেন আজ কয়েকজন তার আগেই এখানে গোছল করতে এসেছে। কিন্তু লোক বালতি আর ক্যানে করে পানি নিয়ে যাচ্ছে। ফুটিয়ে এ পানি পান করা যায়। যদিও ফুটানো পানি বিশুদ্ধ হয় কিন্তু ফুটানো পানি সুস্বাদু নয়- কারণ পানি ফুটালে এর থেকে সব বাতাস বের হয়ে যায়। তিনি গোছল করলেন একটু সময় নিয়ে সাবান ঘষে ধীরে ধীরে পানি ঢাললেন। লেকে সাঁতার কাটার মতো পানি নেই, থাকলে সাঁতার কাটতেন। বাড়ি ফিরে এসে প্রসন্ন মনে ঘরে ঢুকলেন। মিসেস বাটার ফিল্ড জানালেন, কলের নল দিয়ে কাদা আসছে। বাটার ফিল্ড কিচেনের দিকে গেলো। পানি না থাকলে কিভাবে চলবে কিচেনের কাজকর্ম? কিছু পানি অবশ্য জমিয়ে রাখা হয়েছে। এগুলো কিচেনের পিছনে গ্যালনে। মিসেস বাটার ফিল্ড গ্যালনের গায়ে ফায়ার লিখে রেখেছেন। লাল রং দিয়ে এই লেখাগুলো যেন সবার চোখে পড়ে। হায় ঈশ্বর! তা হলে কী হবে তাদের? এই শুষ্ক মওসুমে আগুন থেকে সাবধান থাকা ভাল। তার স্ত্রী এ কথাটা মনে রেখেই কাজটা করে রেখেছে। পাশের বাড়িতেও কিচেনের পিছনে এভাবে পানি রেখেছে কিনা দেখার জন্য দেয়ালের ওপর দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখতে চেষ্টা করলেন বাটার ফিল্ড। সবাই সতর্ক, প্রতিবেশির জন্যও তারা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে প্রস্তুত কিন্তু নিজ পরিবারের দায়িত্বের কথা ভুলে গেলেতো চলবে না। ব্রেকফাস্টের পর বাটার ফিল্ড দুগ্ধ খামার থেকে বড় বড় খালি দুধের ক্যান সংগ্রহ করলেন, সেগুলো ট্রাকে তোলা হলো আর ট্রাক গিয়ে হাজির হলো লেকের কাছে। এগুলো লেকের পানিতে পূর্ণ করে নিয়ে এলেন। হোক পানের অযোগ্য ফুটিয়ে পান করা যাবে তো- এখন তার কিছুটা স্বস্তি লাগছে।
কি. বাটার ফিল্ডকে ট্রাক থেকে একসঙ্গে এত ক্যান নামাতে দেখে প্রতিবেশিরা এসে ভিড় করলো। তারা বৃষ্টির খবরাখবর জানতে চাইলো। বাটার ফিল্ড তাদের কোনো সুখবরই শোনাতে পারলেন না। এখন তারা বাটার ফিল্ডের ক্যানগুলো থেকে কিছু কিছু পানি নিয়ে যার যার বাড়ি চলে গেলো।
নিউইয়র্ক সিটির মানুষের একমাত্র আলোচনার বিষয় হলো পৃথিবীর আর কোনো দেশের মানুষ কি তাদের মতো এভাবে পানির কষ্টের শিকার হচ্ছে? শেষ পর্যন্ত বৃষ্টি এলো আর বৃষ্টির পানিতেই রিজার্ভারগুলো ভরে নেয়া হলো। সমুদ্র পাড়ের লোকেরা বাড়ি ফিরতে শুরু করলো। হোটেলওয়ালাদের এখন আর নতুন কূয়া খুঁড়াখুঁড়ির তাড়াহুড়া নেই। আপাতত চলে যাওয়ার মতো বৃষ্টির পানি পেয়েছে সবাই। মি. বাটার ফিল্ডের প্রতিবেশীরা সবাই খুশি, কারণ তাদের সবারই ছোটখাট খামার আছে। তারা খামারের গরু নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলো বৃষ্টি তাদের দুশ্চিন্তাও অনেকটা লাঘব করে দিয়েছে। এই খরা এবং জলের অভাবে তাদের বিরাট এক শিক্ষা দিয়ে গেছে? ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে না হয় সেজন্য সবাই যথেষ্ট সজাগ। মি. বাটার ফিল্ডের প্রতিবেশিদের কথাবার্তা শোনে তো তাই মনে হলো। অথচ দেশের সব মানুষ কি এই বিষয়টি নিয়ে এমনভাবে ভাবছে? বিশ্ববাসী কি সচেতন এ ব্যাপারে? ১৯৫৭ সালে সামারে প্রচুর পরিমাণ পানি রিজার্ভারে জমা রাখা হলো কিন্তু নিউইয়র্ক এর বাইরে এই সুযোগ ছিলো না।
জুন মাসে কয়েকদিন ওদের বাড়িতে পানি ছিলো না, কি যে কষ্ট গেছে। ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি দিয়ে বাড়ি বাড়ি বালতি বালতি পানি না দিলে জনকষ্টে প্রাণ বেরিয়ে যেতো। নিউ জার্সিতেও পানির ঘাটতি ছিলো, এখন তারা সবাই নিউইয়র্কবাসীদের মতোই সুযোগ ভোগ করছে।
এখন আর পৃথিবীর কোনো দেশেই পানির অভাব নেই, কিন্তু বিশুদ্ধ পানির অভাব পৃথিবীর সর্বত্রই। পরিবেশ দূষণের কারণে পানি দূঘণ হচ্ছে, পানিতে আর্সেনিকসহ অন্যান্য মারাত্মক রাসায়নিকেরও অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে কোনো কোনো অঞ্চলে। আদিম মানুষ যেমন পানিকে জীবন মনে করতো, আধুনিক মানুষও পানিকে জীবনই মনে করে। এ কারণেই বোধ হয় একজন দার্শনিক বলেছিলেন, একদিনের পানের পানি সঙ্গে থাকা মানে একটি দিন পৃথিবীতে বেঁচে থাকার আশা করা।
তথ্যসূত্র
1. Water, Land and People-Barnard Frank New York : Knopf-1950.
2. Water for America-Edwand H. and William van Dersal R. New York Oxford University Press-1956.
3. The Moving Waters- john Collins Stewart, William Sloane Associates-1955.
4. Water and Water Supply- The Basic Science Education Series, Chicago Row, Peterson, 1944
5. Let There Be Bread- Robert, New York : Simon and Schuster 1952.
6. Rivers, Man and Myths- 1958.
7. Water Mircale of Nature, Macmillan-1953.
8. Water- Wealth or Waste William Tryar C and Helen Harcourt Brace & Co-1939.
9. Water for People : Schuman, 1952.
10. Climate Change. Harvard University Press-1953.
Copy from :
No comments